বিশ্ব

হংকংয়ে বিমান দুর্ঘটনা: সাগরে কার্গো প্লেন, নিহত ২

Advertisement

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার ভোরে একটি কার্গো প্লেন অবতরণের সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে সাগরে পড়ে যায়। হতাহতদের মধ্যে দুজন ছিলেন বিমানবন্দরের কর্মী, আর প্লেনের চারজন ক্রু সদস্যকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি পুরো হংকংসহ বৈশ্বিক বিমান পরিবহন জগতে গভীর শোকের ছায়া ফেলেছে।

দুর্ঘটনার সময় ও পরিস্থিতি

সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে দুবাই থেকে আসা তুরস্কের কার্গো বিমান এয়ার এ সি টি কার্গো হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমিরেটসের পক্ষে পরিচালিত ফ্লাইট ইকেএ ৯৭৮৮ নামের এ বিমানে শুধুমাত্র পণ্য পরিবহন করা হচ্ছিল।

অবতরণের সময় উত্তর দিকের রানওয়েতে বিমানটি হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং একটি গ্রাউন্ড সার্ভিস যানবাহনের সঙ্গে ধাক্কা খায়। সংঘর্ষের পর মুহূর্তের মধ্যেই বিমানটি রানওয়ে থেকে ছিটকে গিয়ে সোজা সাগরে পড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বিমানবন্দরে অবস্থানরত কর্মী ও যাত্রীদের মধ্যে।

হতাহতের ঘটনা

হংকং পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দুর্ঘটনায় বিমানবন্দরের দুইজন গ্রাউন্ড স্টাফ সাগরে পড়ে গিয়েছিলেন। দ্রুত উদ্ধার অভিযান শুরু করা হয়। হেলিকপ্টার ও উদ্ধার জাহাজ ব্যবহার করে তাদের পানি থেকে তোলা হলেও হাসপাতালে নেওয়ার পর দুজনকেই মৃত ঘোষণা করা হয়। নিহতদের একজন ছিলেন অভিজ্ঞ টেকনিক্যাল সহকারী এবং অন্যজন রানওয়ে সেফটি কর্মী।

অন্যদিকে, বিমানে থাকা চারজন ক্রু সদস্যকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হলেও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তারা বর্তমানে স্থিতিশীল আছেন।

তৎক্ষণাৎ উদ্ধার অভিযান

দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হংকং সরকারের ফ্লাইং সার্ভিসের হেলিকপ্টার, ফায়ার সার্ভিসের নৌযান এবং বিমানবন্দরের নিজস্ব উদ্ধার টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় বিমানের ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ উদ্ধার করা হয়।

বিমানটি পানিতে পড়ার সময় এতে থাকা জ্বালানির কিছু অংশ সমুদ্রের পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং আশপাশের এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সুরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে।

রানওয়ে বন্ধ, অন্যান্য ফ্লাইট বাতিল

দুর্ঘটনার পরপরই বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট রানওয়েটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে বিমানবন্দরের অন্য দুইটি রানওয়ে চালু রাখা হয় যাতে জরুরি বিমান চলাচল ব্যাহত না হয়।

হংকং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুর্ঘটনার পর অন্তত ১১টি কার্গো ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে এবং কিছু যাত্রীবাহী ফ্লাইট বিকল্প রানওয়ে দিয়ে অবতরণ করছে।

বিমানবন্দরের বিবৃতি

হংকং সিভিল অ্যাভিয়েশন বিভাগের এক বিবৃতিতে বলা হয়,

“আমরা গভীরভাবে শোকাহত। দুইজন দক্ষ কর্মীর মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু হয়েছে। উদ্ধার হওয়া চারজন ক্রু সদস্যের চিকিৎসা চলছে এবং তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।”

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের ঘোষণা দেয়। সেখানে কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অবতরণের সময় ভারী কুয়াশা ও ভিজে রানওয়ে এই দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ হতে পারে।

এয়ারলাইনের প্রতিক্রিয়া

দুর্ঘটনায় জড়িত তুরস্কের কার্গো এয়ারলাইন এয়ার এ সি টি-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়,

“আমাদের বিমানটি এমিরেটসের জন্য কার্গো পরিবহন করছিল। হংকং পৌঁছানোর সময় একটি অপ্রত্যাশিত যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়, যা পাইলট নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। আমরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি।”

এয়ারলাইনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরও বলেন, “আমরা নিহতদের পরিবারের পাশে রয়েছি এবং আহত ক্রু সদস্যদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।”

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ

বিমানবন্দরের এক কর্মী জানান, “আমি হঠাৎ করে প্রচণ্ড শব্দ শুনে বাইরে ছুটে যাই। দেখি, রানওয়ের শেষ প্রান্তে আগুনের শিখা এবং ধোঁয়া উঠছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই বুঝতে পারি একটি বিমান সাগরে পড়ে গেছে।”

অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “বিমানের ল্যান্ডিং লাইটগুলো ঝলমল করছিল, কিন্তু হঠাৎ সেটা ডানদিকে বেঁকে যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।”

তদন্ত শুরু

দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে হংকং সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি। ইতোমধ্যে বিমানের ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা হয়েছে। এতে থাকা তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যাবে বিমানের গতি, উচ্চতা, এবং পাইলটের নির্দেশনা—যা দুর্ঘটনার কারণ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি হয়তো যান্ত্রিক ত্রুটি অথবা পাইলটের সিদ্ধান্তজনিত সমস্যা হতে পারে। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই দুর্ঘটনার খবরে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা আইকাও (ICAO) এবং ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (IATA) শোক প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, “হংকং বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ বিমানবন্দরগুলোর একটি, সেখানে এমন দুর্ঘটনা বিরল ঘটনা।”

দুবাইয়ের বিমান কর্তৃপক্ষও হংকং সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে তদন্তে সহায়তা করছে।

নিরাপত্তা রেকর্ড ও পূর্বের ঘটনা

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিগত দুই দশকে বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ বিমানবন্দর হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৮ সালে চালু হওয়ার পর থেকে সেখানে বড় ধরনের বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি।

তবে ২০১০ সালে একবার একটি কার্গো ফ্লাইট অবতরণের পর হালকা আগুন ধরে যায়, কিন্তু দ্রুত তা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। আর এবারের দুর্ঘটনা সেই তুলনায় অনেক বেশি ভয়াবহ, কারণ এতে প্রাণহানি ঘটেছে এবং বিমানটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।

পরিবেশগত প্রভাব

বিমানটি সাগরে পড়ার পর জ্বালানি তেল পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, এটি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে হংকং মেরিন ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে, তারা তেল ছড়িয়ে পড়া রোধে তৎক্ষণাৎ ভাসমান প্রতিবন্ধক বসিয়েছে এবং পানি পরিশোধনের কাজ শুরু করেছে।

নিহতদের স্মরণে শোক

হংকংয়ের মুখ্য নির্বাহী জন লি এক বিবৃতিতে বলেন,

“আমরা আমাদের সাহসী বিমানবন্দর কর্মীদের শ্রদ্ধা জানাই, যারা প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। এই দুর্ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নিরাপত্তার প্রতিটি ধাপ কতটা গুরুত্বপূর্ণ।”

বিমানবন্দরে আজ পতাকা অর্ধনমিত রেখে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

ভবিষ্যতে করণীয়

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে আরো উন্নত অবতরণ ব্যবস্থা ও আবহাওয়া বিশ্লেষণ প্রযুক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। হংকং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, তারা পুরো অবতরণ প্রক্রিয়া পুনর্মূল্যায়ন করবে।

ঘটনার সারসংক্ষেপ

  • বিমান: এয়ার এ সি টি কার্গো (ফ্লাইট ইকেএ ৯৭৮৮)
  • উৎস: দুবাই
  • গন্তব্য: হংকং
  • সময়: স্থানীয় সময় ভোর ৩টা ৫০ মিনিট
  • নিহত: ২ (বিমান বন্দর কর্মী)
  • আহত: ৪ (ক্রু সদস্য)
  • উদ্ধার অভিযান: হেলিকপ্টার ও নৌযান
  • রানওয়ে: সাময়িকভাবে বন্ধ
  • তদন্ত: চলমান

MAH – 13391 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button