
গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফাহ শহরে আবারও বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। স্থানীয় সময় রোববার বিকেলে সংঘটিত এ হামলায় বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নিহত ও আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।
এই হামলার ফলে ইসরায়েল আবারও যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা ফের বাড়িয়ে তুলেছে।
হামলার বিস্তারিত ও ইসরায়েলের অবস্থান
ফিলিস্তিনি সূত্রে জানা যায়, রোববার দুপুরে রাফাহ শহরের পূর্বাংশে টানা দুই দফা বিমান হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, হামলার সময় এলাকাজুড়ে তীব্র বিস্ফোরণ ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়।
ইসরায়েলের চ্যানেল ১২ জানায়, এই হামলার লক্ষ্য ছিল ইয়াসের আবু শাবাব নেতৃত্বাধীন একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী, যাদের বিরুদ্ধে মানবিক সহায়তা লুটপাট ও ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে। তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করছে, এই অভিযান ছিল হামাসের পাল্টা আক্রমণের প্রতিক্রিয়া।
ইসরায়েলি এক সামরিক মুখপাত্র বলেন, “হামাস যোদ্ধারা রকেটচালিত গ্রেনেড ও স্নাইপার অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলি অবস্থানে আক্রমণ চালিয়েছে, যা যুদ্ধবিরতির স্পষ্ট লঙ্ঘন।” তিনি আরও দাবি করেন, ইসরায়েল শুধু আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে।
হামাসের প্রতিক্রিয়া ও নতুন উত্তেজনা
অন্যদিকে হামাস জানিয়েছে, তারা এখনও যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। সংগঠনটির রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য ইজ্জাত আল-রিশেক এক বিবৃতিতে বলেন, “দখলদার ইসরায়েলই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে এবং তাদের অপরাধ ঢাকতে হামাসকে দোষারোপ করছে।”
তিনি আরও বলেন, “হামাস আন্দোলন শান্তি চুক্তি মেনে চলছে। ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘাত উসকে দিচ্ছে, যাতে তারা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের অজুহাত তৈরি করতে পারে।”
রাফাহ ছাড়াও গাজার উত্তরাঞ্চল জাবালিয়া ক্যাম্পেও একইদিনে ইসরায়েলি বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে। ফিলিস্তিনি সূত্র বলছে, এসব হামলায় অন্তত ৮ জন নিহত ও আরও ২০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি
গত ১১ অক্টোবর কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, উভয় পক্ষই সামরিক অভিযান থেকে বিরত থাকবে এবং মানবিক সহায়তা অবাধে গাজার ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে। তবে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের দাবি, ইসরায়েল এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ বারের বেশি এই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।
এই সময়ের মধ্যে ইসরায়েলি হামলায় ৩৮ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। এছাড়া ইসরায়েল মানবিক সহায়তা সরবরাহেও বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে রাফাহ সীমান্তে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ কঠোর করায় মিসর থেকেও সাহায্য পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নিন্দা
এই হামলার পর জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত টর ওয়েনেসল্যান্ড উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করে যে কোনো হামলা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। উভয় পক্ষের উচিত restraint অবলম্বন করা।”
কাতার ও তুরস্কও এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। দোহা থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “রাফাহে বেসামরিক মানুষের ওপর এই হামলা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।”
অন্যদিকে মিসরীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে তারা নতুন উদ্যোগ নিতে মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসছে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও নেতানিয়াহুর অবস্থান
ইসরায়েলি রাজনীতিতে এই হামলা নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ইসরায়েলি চরমপন্থী মন্ত্রী ইতামার বেন গাভির ও বেজালেল স্মোত্রিচ ইতোমধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বেন গাভির এক বিবৃতিতে বলেছেন, “গাজায় আবারও পূর্ণ শক্তিতে যুদ্ধ শুরু করতে হবে, যাতে হামাসকে চিরতরে নির্মূল করা যায়।” অন্যদিকে স্মোত্রিচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক শব্দে লিখেছেন, “যুদ্ধ।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তার জোটের চাপের মুখে রয়েছেন। তিনি যদি হামলা বন্ধ রাখেন, তবে ডানপন্থী জোটের সমর্থন হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। আবার হামলা চালালে আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র প্রতিক্রিয়া বাড়বে — এই দ্বিধার মধ্যেই অবস্থান করছেন নেতানিয়াহু।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য পরিণতি
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকদের মতে, রাফাহে নতুন হামলা যদি অব্যাহত থাকে, তবে পুরো গাজা অঞ্চলে যুদ্ধবিরতি কার্যত শেষ হয়ে যাবে। এতে মানবিক সংকট আরও তীব্র হবে এবং সহস্রাধিক মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে।
একজন স্থানীয় অধিবাসী বলেন, “আমরা প্রতিদিন মৃত্যুভয়ে বাঁচি। যুদ্ধবিরতি শুধু কাগজে আছে, বাস্তবে তা নেই।”
বিশ্লেষকদের মতে, এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে ফেরানো, নইলে এই সংঘাত দ্রুতই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
“ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে এই নতুন সংঘর্ষ যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে,”—মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ড. হাসান আল-মাহমুদ।
রাফাহ শহরের সর্বশেষ হামলা মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করেছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তির কার্যকারিতা এখন বড় প্রশ্নের মুখে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ইসরায়েল যদি এই ধরনের সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখে, তবে শান্তি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসবে।
এম আর এম – ১৮৪২,Signalbd.com