
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধের নাম পরিবর্তন করে “দ্য ওয়ার অব রিডেম্পশন” বা “মুক্তিযুদ্ধ” করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
রোববার (১৯ অক্টোবর) জেরুজালেমে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক বৈঠকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। নেতানিয়াহু বলেন, “গাজায় যে যুদ্ধ চলছে, এটি ইসরায়েলি জাতির পুনরুদ্ধার ও স্বাধীনতার যুদ্ধ।”
গাজা যুদ্ধের নতুন নামকরণে নেতানিয়াহুর যুক্তি
মন্ত্রিসভার বৈঠকের শুরুতেই নেতানিয়াহু বলেন, “আজ আমি সরকারের কাছে গাজা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক নামকরণের প্রস্তাব জমা দিচ্ছি — দ্য ওয়ার অব রিডেম্পশন, অর্থাৎ মুক্তির যুদ্ধ।”
তিনি আরও বলেন, “৭ অক্টোবরের ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর আমরা দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছি। হামাসের ভয়াবহ হামলার জবাবে ইসরায়েল এক কঠিন কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। এটি ছিল আমাদের জাতির জন্য সত্যিকারের এক মুক্তিযুদ্ধ।”
বৈঠক শেষে এক ভিডিও বার্তায় তিনি যোগ করেন, “গাজায় যা ঘটেছে, তা ইসরায়েলি জাতির আত্মরক্ষার লড়াইয়েরই ধারাবাহিকতা। এটি আমাদের জাতির স্বাধীনতা ও পুনর্জাগরণের প্রতীক।”
হামাসের হামলার পর প্রেক্ষাপট
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্তে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। ওই আক্রমণে প্রায় ১২০০ জন ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হন, এবং ২০০-এর বেশি ব্যক্তি জিম্মি হন।
এরপর থেকেই ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা ও স্থল অভিযানে নামে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই সংঘাতে গাজায় ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু।
নেতানিয়াহুর মতে, এই যুদ্ধ কেবল সামরিক সংঘাত নয়, বরং ইসরায়েলি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার এক লড়াই — “আমরা শুধু গাজার সঙ্গে যুদ্ধ করছি না, আমরা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য লড়ছি,” তিনি বলেন।
সৈন্যদের বীরত্বের স্বীকৃতি আসছে
নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নেওয়া ইসরায়েলি সৈন্যদের “বীরত্বের খেতাব” প্রদান করা হবে।
তিনি বলেন, “আমাদের সেনারা গাজায় অভূতপূর্ব সাহসিকতা দেখিয়েছে। তারা শুধু দেশের সীমানা নয়, আমাদের জাতির মর্যাদাও রক্ষা করেছে। সরকার শিগগিরই তাদের সম্মান জানাবে।”
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন, একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা হয়েছে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের মধ্যে বীরত্বসূচক পদক প্রদান করবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক
নেতানিয়াহুর প্রস্তাব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একদিকে ইসরায়েলের অনেক নাগরিক ও সরকারপন্থি গোষ্ঠী এই নামকরণকে “জাতীয় গৌরবের প্রতীক” হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছে, অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো একে “রাজনৈতিক প্রচারণা” হিসেবে সমালোচনা করেছে।
প্যালেস্টাইনের কর্মকর্তারা বলেছেন, “যে যুদ্ধ হাজারো সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, সেটিকে মুক্তিযুদ্ধ বলা ইতিহাস বিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়।”
এমনকি ইসরায়েলি বিরোধী দলগুলোর কয়েকজন সংসদ সদস্যও মন্তব্য করেছেন, “নাম পরিবর্তন করলে যুদ্ধের বাস্তবতা বদলায় না। জনগণ শান্তি চায়, নতুন নাম নয়।”
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে নামকরণের তাৎপর্য
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহুর এই প্রস্তাব দেশীয় রাজনীতিতে তার অবস্থান শক্ত করার একটি কৌশল।
তেল আবিব ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. ইয়োসি ক্লাইন বলেন, “নেতানিয়াহু চাচ্ছেন যুদ্ধকে একটি আদর্শিক বা ঐতিহাসিক চরিত্র দিতে। এতে যুদ্ধের ব্যর্থতা আড়াল করে জাতীয়তাবাদী আবেগ উস্কে দেওয়া সম্ভব।”
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, যুদ্ধের নাম “মুক্তিযুদ্ধ” ঘোষণা করে ইসরায়েল তাদের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছে।
একই সঙ্গে এটি ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহর প্রতি একটি রাজনৈতিক বার্তাও বটে — “ইসরায়েল এখনও শক্ত অবস্থানে আছে।”
গাজায় চলমান পরিস্থিতি
যদিও নেতানিয়াহুর প্রস্তাব ইসরায়েলের অভ্যন্তরে সমর্থন পাচ্ছে, তবু গাজার পরিস্থিতি এখনও ভয়াবহ। শনিবার রাতেই ইসরায়েলি বাহিনী নতুন করে গাজা সিটির কয়েকটি এলাকায় বিমান হামলা চালিয়েছে।
প্যালেস্টাইনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সাম্প্রতিক ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৫৬ জন নিহত হয়েছেন।
অন্যদিকে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, হামাসের একাধিক রকেট ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়েছে এবং তাদের কয়েকজন শীর্ষ কমান্ডার নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যুদ্ধবিরতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “যুদ্ধের নাম যাই হোক না কেন, শান্তির বিকল্প নেই।”
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচও ইসরায়েলকে আহ্বান জানিয়েছে গাজার মানবিক সহায়তা অবরোধ তুলে নিতে।
তারা বলেছে, “মানবিক সংকট এখন ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে, এবং এ অবস্থায় যুদ্ধকে গৌরবের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা অনৈতিক।”
প্রতীকী নাম না বাস্তব সমাধান?
নেতানিয়াহুর প্রস্তাবিত “মুক্তিযুদ্ধ” নামটি এখন ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
একদিকে এটি জাতীয় গর্ব ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে, অন্যদিকে এটি যুদ্ধের বাস্তব মানবিক বিপর্যয় ঢাকার প্রচেষ্টা হিসেবেও সমালোচিত।
বিশ্লেষকদের মতে, “নাম পরিবর্তনে নয়, সমাধান আসবে শান্তি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই।”
তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে — গাজার এই মুক্তিযুদ্ধ কবে সত্যিকার অর্থে শান্তির মুক্তি বয়ে আনবে?
এম আর এম – ১৮৩৯,Signalbd.com