
বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় নেশার টাকার জন্য দাদাকে পিটিয়ে হত্যা করে নিজেই থানায় আত্মসমর্পণ করেছে এক নেশাগ্রস্ত নাতি। মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটেছে রোববার সকাল ৮টার দিকে ভবানীপুর ইউনিয়নের চণ্ডিপুর গ্রামে।
স্থানীয়রা বলছেন, ঘটনাটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি সমাজে মাদক নামের ভয়ঙ্কর অভিশাপের আরেকটি নির্মম চিত্র।
ঘটনার বিবরণ
নিহতের নাম সাবান আলী ফকির (৬৫), তিনি চণ্ডিপুর গ্রামের মৃত নবির আলী ফকিরের ছেলে। অভিযুক্ত নাতির নাম আশিক হোসেন রানা (২৬), পিতা আবু সাইদ সাইফুল।
পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রানা দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত ছিল। সে ইয়াবা, গাঁজা ও মাঝে মাঝে ফেনসিডিল সেবন করত বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। নেশার টাকার জন্য প্রায়ই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার ঝগড়া লেগেই থাকত।
রোববার সকালে রানা দাদা সাবান আলীর কাছে টাকা চায়। সাবান আলী নেশার জন্য টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে রানা। কিছুক্ষণ পর রাস্তায় একা পেয়ে দাদার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে। স্থানীয়রা দৌড়ে এলে দেখা যায়, সাবান আলী মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।
এরপর পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আশিক হোসেন রানা নিজেই শেরপুর থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে বলে নিশ্চিত করেছেন থানা পুলিশ।
পুলিশের বক্তব্য
শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মঈনুদ্দীন বলেন,
“আশিক হোসেন রানা একজন নেশাগ্রস্ত যুবক। সে নেশার টাকার জন্য পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করত। আজ সকালে টাকা না পেয়ে দাদাকে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে নিজেই থানায় এসে জানায়, ‘আমি আমার দাদাকে মেরে ফেলেছি।’ অভিযুক্তকে আটক করা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে।”
ওসি আরও জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রানা স্বীকার করেছে যে, সে নেশার টাকার জন্যই এই কাজ করেছে। তার মানসিক অবস্থাও স্থিতিশীল নয় বলে ধারণা করছে পুলিশ।
গ্রামের মানুষের প্রতিক্রিয়া
চণ্ডিপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল হালিম বলেন,
“রানা আগে খুব ভালো ছেলে ছিল। কিন্তু তিন বছর ধরে নেশায় জড়িয়ে পড়ে পুরো পরিবারটা ভেঙে দিয়েছে। তার বাবা-মা কিছুই করতে পারেনি। আজ সে নিজের দাদাকেই মেরে ফেলল, ভাবা যায়!”
আরেকজন স্থানীয় নারী রুকাইয়া বেগম বলেন,
“আমরা অনেকবার ওর বাবা-মাকে বলেছিলাম ছেলেকে চিকিৎসা করাতে, কিন্তু তারা পারছিল না। টাকা-পয়সা ছিল না, আর রানা কারও কথা শুনত না।”
পরিবারের কান্নায় ভেঙে পড়া দৃশ্য
সাবান আলী ফকিরের মৃত্যুতে পুরো পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। গ্রামের মসজিদের পাশে তার লাশ রাখা হলে শত শত মানুষ জড়ো হয়।
নিহতের ছেলে আবু সাইদ সাইফুল, যিনি একই সঙ্গে রানার বাবা, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন,
“ছেলেটা নেশায় পাগল হয়ে গেছে। আমি চেষ্টা করেছি, অনেক বুঝিয়েছি, তবুও শুনেনি। আজ সে আমার বাবাকে কেড়ে নিল। আমারও আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।”
মাদক ও পারিবারিক অপরাধের ভয়াবহতা
বাংলাদেশে মাদকাসক্তি এখন এক সামাজিক ব্যাধি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র — সবাই এর ভয়াবহ প্রভাবের শিকার হচ্ছে।
বগুড়ার শেরপুর থানার তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাদক সংক্রান্ত অপরাধের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। এর মধ্যে পারিবারিক সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকাসক্তি কেবল ব্যক্তির শারীরিক ক্ষতি করে না, এটি তার মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট করে দেয়। ফলে অনেক সময় নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি পরিবার ও সমাজের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল ইসলাম বলেন,
“নেশা মানুষকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে যায় যেখানে সে নিজের প্রিয়জনকেও শত্রু মনে করে। পারিবারিক সহিংসতার বড় অংশই এখন মাদক সংশ্লিষ্ট।”
মাদক নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা
বগুড়া জেলা পুলিশ জানায়, সম্প্রতি শেরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলায় মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে বগুড়ায় অন্তত ৮৫০ জন মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে স্থানীয় মানুষ বলছেন, শুধু অভিযান নয়, দরকার পুনর্বাসন ও সচেতনতা।
শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহীনুর রহমান বলেন,
“এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। পরিবার ও সমাজকে এখনই একসঙ্গে মাদকবিরোধী আন্দোলনে নামতে হবে। শুধু আইন নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও নেশাগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে।”
বাংলাদেশে মাদকাসক্তির পরিসংখ্যান (সংক্ষিপ্ত তথ্য)
- দেশে বর্তমানে আনুমানিক ৭০ লাখের বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মাদকাসক্ত (সূত্র: ডিএনসি ২০২৪)।
- এর মধ্যে ৬৫% তরুণ বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
- পরিবারে মাদকাসক্ত সদস্য থাকলে সেখানে সহিংসতা ও অস্থিরতা বেড়ে যায় প্রায় ৪ গুণ।
- প্রতি বছর মাদক সংক্রান্ত পারিবারিক হত্যা বা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে প্রায় ৩০০টির বেশি।
মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে করণীয়
সামাজিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে কেবল আইনের কড়াকড়ি নয়, শিক্ষা, সচেতনতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পারিবারিক ভালোবাসার বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব:
- স্কুল-কলেজে নিয়মিত মাদকবিরোধী সচেতনতা ক্লাস।
- প্রতিটি ইউনিয়নে পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন।
- মাদকাসক্তদের চিকিৎসায় সরকারি সহায়তা বাড়ানো।
- পরিবারে খোলামেলা যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
- স্থানীয় মসজিদ-মন্দির থেকে মাদকবিরোধী প্রচারণা চালানো।
চণ্ডিপুর গ্রামের এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবারের নয়, এটি সমগ্র সমাজের জন্য এক করুণ সতর্কবার্তা।
একজন নেশাগ্রস্ত যুবকের হাতে নিজের দাদার মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয় — নেশা কেবল শরীর নয়, মন, বিবেক এবং ভালোবাসাকে ধ্বংস করে দেয়।
এই ঘটনাটি হয়তো পুলিশের নথিতে আরেকটি মামলা হিসেবেই থাকবে, কিন্তু সমাজের বিবেকবান মানুষদের জন্য এটি হওয়া উচিত একটি জাগরণের প্রতীক — যেন আর কোনো রানা তার দাদাকে হারিয়ে ফেলে না, আর কোনো সাবান আলী নেশার শিকার না হয়।
সংক্ষেপে ঘটনার সারমর্ম
বিষয় | তথ্য |
---|---|
ঘটনার স্থান | চণ্ডিপুর গ্রাম, ভবানীপুর ইউনিয়ন, শেরপুর, বগুড়া |
ঘটনার সময় | ১৯ অক্টোবর ২০২৫, সকাল ৮টা |
নিহত ব্যক্তি | সাবান আলী ফকির (৬৫) |
অভিযুক্ত | আশিক হোসেন রানা (২৬) |
কারণ | নেশার টাকার জন্য পারিবারিক বিরোধ |
পরিণতি | দাদাকে হত্যা করে থানায় আত্মসমর্পণ |
বর্তমান অবস্থা | অভিযুক্ত থানায় আটক, মামলা প্রক্রিয়াধীন |
MAH – 13389 I Signalbd.com