
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ইতোমধ্যে সরগরম হয়ে উঠেছে।
একদিকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার কাজ প্রায় শেষ করেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ব্যস্ত তাদের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বাছাইয়ের চূড়ান্ত ধাপে।
তবে এবার আগের মতো তদবির, প্রভাব বা সুপারিশে নয়— মনোনয়ন নির্ধারিত হবে ডিজিটাল যাচাই-বাছাই ও নিজস্ব তথ্য বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি এবার মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ নতুন ধারা চালু করেছে।
প্রতিটি সম্ভাব্য প্রার্থীর জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি ডিজিটাল ডেটাবেজ, যেখানে রাখা হচ্ছে রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত যোগ্যতার বিস্তারিত তথ্য।
এই ডেটাবেজের ভিত্তিতে প্রার্থীদের স্বয়ংক্রিয় র্যাংকিং (Automatic Ranking) তৈরি হবে। এরপরই সেই ফলাফল যাবে দলের উচ্চ পর্যায়ের মনোনয়ন বোর্ডে।
অর্থাৎ এবার প্রার্থীর প্রচার বা সম্পর্ক নয়, বরং ডেটা ও বাস্তব তথ্যই নির্ধারণ করবে কে হবেন বিএনপির প্রার্থী।
বিএনপির মনোনয়ন যাচাইয়ের ৫টি অযোগ্যতার বিষয়
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপি এবার প্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যোগ্যতা নয়, বরং অযোগ্যতার মানদণ্ডও নির্ধারণ করেছে।
এই পাঁচটি বিষয়ে যদি কারও বিরুদ্ধে সত্যতা পাওয়া যায়, তবে তিনি প্রাথমিক তালিকা থেকেই বাদ পড়বেন।
সেগুলো হলো:
- দলের সঙ্গে বিদ্রোহ বা ভিন্নমত:
যেসব নেতা অতীতে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন, ভিন্ন গ্রুপ তৈরি করেছেন বা দলের ক্ষতি করেছেন— তাদের মনোনয়ন পাওয়ার সুযোগ একেবারেই নেই। - ফৌজদারি অপরাধ বা দুর্নীতির মামলা:
রাজনৈতিক মামলা নয়, কিন্তু যদি কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ, অর্থনৈতিক অনিয়ম, বা জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের প্রমাণ থাকে, তবে তাঁকেও বাদ দেওয়া হবে। - আওয়ামী লীগ থেকে সুবিধা গ্রহণ:
গত ১৫ বছরে যদি কেউ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সরকার বা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে থাকেন, সেটি মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। - স্থানীয় রাজনীতিতে অপরাধে সম্পৃক্ততা:
বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে কেউ যদি স্থানীয় পর্যায়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে থাকেন, তা সঙ্গে সঙ্গে মনোনয়ন বাতিলের কারণ হবে। - নির্বাচনী এলাকায় জনগ্রহণযোগ্যতার অভাব:
প্রার্থী যদি তার এলাকায় জনপ্রিয় না হন, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল হয় বা তার ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, তাহলেও মনোনয়ন বাতিল করা হবে।
শুধু যোগ্যতা নয়, রাজনৈতিক চরিত্রও বিশ্লেষণে
দলের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, বিএনপি এবার প্রার্থীদের শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, বরং তাঁদের জনসম্পৃক্ততা, নৈতিক অবস্থান, পারিবারিক ঐতিহ্য ও সামাজিক ভাবমূর্তিও বিবেচনায় নিচ্ছে।
প্রতিটি প্রার্থীর জন্য তৈরি করা হয়েছে প্রায় ১০টি মূল প্রশ্ন ও আরও ৫ থেকে ৭টি উপশ্রেণি, যেগুলোর উত্তর বিশ্লেষণ করে তৈরি হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল।
এই তথ্য যাচাইয়ে দলের নিজস্ব আইটি টিম ও গবেষণা ইউনিট কাজ করছে দিনরাত।
একজন দলের যুগ্ম মহাসচিব জানিয়েছেন,
“আমরা চাই, বিএনপির ব্যানারে এমন প্রার্থী দাঁড়াক, যিনি সততা, যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতায় জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেন। আমাদের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতেও তাঁরা হতে হবে পরিচ্ছন্ন ও বিশ্বাসযোগ্য।”
সালাহউদ্দিন আহমদের ইঙ্গিত: আসছে ‘গ্রীণ সিগন্যাল’
সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমে জানান,
দল এখন চূড়ান্ত ধাপের যাচাই-বাছাইয়ে আছে। শিগগিরই প্রতিটি আসনে একজন করে একক প্রার্থীকে ‘গ্রীণ সিগন্যাল’ দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন,
“আমরা চাই, এই নির্বাচনে বিএনপির ব্যানারে কেউ যেন কেবল ব্যক্তিগত কারণে নয়, দল ও দেশের স্বার্থে লড়েন। সেই লক্ষ্যে মনোনয়ন যাচাইয়ে আমরা এবার সর্বোচ্চ কঠোরতা অবলম্বন করছি।”
এ সময় তিনি আরও জানান, দলের দেশব্যাপী নির্বাচনকেন্দ্রিক গণসংযোগ কর্মসূচি আরও জোরদার করা হবে।
স্থানীয় পর্যায়ে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে— জনগণের পাশে থেকে আস্থা অর্জনের কাজ শুরু করতে।
ডিজিটাল যুগের মনোনয়ন: সাক্ষাৎকার নয়, তথ্যই প্রমাণ
অতীতে বিএনপি মনোনয়নপ্রার্থীদের সাক্ষাৎকার, সুপারিশ বা রাজনৈতিক তদবিরের ওপর বেশি গুরুত্ব দিত।
কিন্তু এবার সেই প্রথা পুরোপুরি বদলে যাচ্ছে।
দলটি জানায়, এবার নিজস্ব তথ্যভাণ্ডার (Database), সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্যক্রম, এবং রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণ করেই মনোনয়ন দেওয়া হবে।
ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইউটিউবসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে প্রার্থীদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
যারা দলের নীতি ও নেতৃত্বকে ধারাবাহিকভাবে সমর্থন করেছেন, সংগঠনের প্রতি আনুগত্য রেখেছেন, তাদেরই প্রাধান্য দেওয়া হবে।
এই উদ্যোগকে দলের ভেতরে অনেকে বলছেন “ডিজিটাল যাচাইয়ের রাজনীতি”— যা বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতিতে এক নতুন ধারা।
কেন এত কঠোর হচ্ছে বিএনপি?
বিএনপি নেতৃত্ব মনে করছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
তাই প্রার্থী বাছাইয়ে সামান্য ভুলও দলকে বড় ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।
সেই কারণেই এবার প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাইয়ে কোনো ছাড় দিচ্ছে না দলটি।
একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন,
“আগের মতো ‘জনপ্রিয়’ বা ‘পুরোনো’ নেতা বলেই কেউ মনোনয়ন পাবেন না। মাঠে কে কাজ করেছেন, কে জনগণের পাশে ছিলেন, সেটা দেখা হচ্ছে খুঁটিয়ে।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“যারা দলের আন্দোলনে ত্যাগ করেছেন, নির্যাতন সয়েছেন, মামলা-মোকদ্দমা লড়েছেন— তাদের প্রাধান্য দেওয়া হবে।”
বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক প্রস্তুতি
অন্যদিকে বিএনপির মতো অন্যান্য দলও নির্বাচনের প্রস্তুতিতে পিছিয়ে নেই।
আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ইতোমধ্যে ১০৯টি আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে।
এছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চ, যা ছয় দলের একটি জোট, তারা ১৪০টি আসনের প্রার্থীর নাম প্রকাশ করেছে এবং সব ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলীয় প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময় অনুযায়ী নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে।
তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২৯৬টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, যা শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।
এতে স্পষ্ট যে, আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এখন একপ্রকার পূর্ণ প্রস্তুতিতে রয়েছে।
দলীয় হাইকমান্ডের কড়া বার্তা
বিএনপির হাইকমান্ডের বার্তা স্পষ্ট—
দলীয় স্বার্থের বাইরে কোনো ব্যক্তিস্বার্থের জায়গা থাকবে না।
যে কেউ দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার মতো কর্মকাণ্ডে জড়াবেন, তাঁর বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন,
“আমরা চাই, বিএনপি জনগণের আস্থার প্রতীক হোক। এজন্য মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রত্যেক প্রার্থীকে হতে হবে পরিশুদ্ধ, স্বচ্ছ ও আদর্শবান।”
তিনি আরও বলেন,
“আগামী নির্বাচনে আমরা জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে চাই। এজন্য যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।”
বিএনপির নতুন কৌশল কি সফল হবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি এবার যেভাবে প্রযুক্তিনির্ভর ও কঠোর যাচাইয়ের পথে হাঁটছে, তা একদিকে দলের ভাবমূর্তি ইতিবাচক করবে, অন্যদিকে অনেক বিতর্কিত নেতার জায়গা সংকুচিত করবে।
তবে এতে দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা ও অসন্তোষও বাড়তে পারে।
কারণ, অনেক প্রভাবশালী নেতা এবার হয়তো বাদ পড়বেন, আর জায়গা পাবেন মাঠের ত্যাগী কর্মীরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবুল হক বলেন,
“বিএনপি যদি এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াকে সত্যিকারভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে এটি তাদের জন্য গেম চেঞ্জার হতে পারে। জনগণ দেখতে পাবে, দলটি সত্যিই পরিবর্তন চায়।”
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে এক নতুন দৃষ্টান্ত।
তথ্যনির্ভর যাচাই, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থান— এগুলো যদি বাস্তবে কার্যকর করা যায়, তবে বিএনপি আগামীর নির্বাচনে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
তবে সবকিছুই নির্ভর করবে দলের একনিষ্ঠতা ও মাঠ পর্যায়ের বাস্তব প্রয়োগের ওপর।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন নজর সেদিকেই—
বিএনপি কি সত্যিই নতুন রূপে ফিরতে পারবে?
MAH – 13386 I Signalbd.com