বাংলাদেশ

স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে যুবকের মর্মান্তিক আত্মহত্যা

Advertisement

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে স্বপন মিয়া (২৫) নামের এক তরুণ নিজের জীবনের ইতি টেনেছেন। শনিবার (১৯ অক্টোবর) দিবাগত রাতে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। পরিবারের সঙ্গে ক্ষণিকের অভিমান, মনোমালিন্য—সব মিলিয়ে এক মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্ত চিরতরে নিভিয়ে দিলো একটি তরুণ প্রাণের আলো।

ঘটনার শুরু

স্বপন মিয়া ভোলা জেলার লালমোহন থানার দেওয়ানকান্দি গ্রামের বজলু মিয়ার ছেলে। জীবিকার তাগিদে তিনি কয়েক বছর আগে রাজধানী ঢাকায় আসেন। বর্তমানে তিনি মোহাম্মদপুর থানার চন্দ্রিমা মডেল টাউনের বি ব্লকে হানিফ কোম্পানির ভাড়া বাসায় স্ত্রী তানিয়া বেগমের সঙ্গে বসবাস করছিলেন।

পরিবারের প্রতিবেশী সূত্রে জানা যায়, স্বপন ছিলেন পরিশ্রমী ও নিরহংকারী স্বভাবের একজন যুবক। কয়েক মাস আগে বিয়ের পর থেকে স্ত্রী তানিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্কই ছিলো। তবে মাঝে মধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হতো।

সেই রাতে যা ঘটেছিল

তানিয়া বেগম জানান, শনিবার গভীর রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামান্য কথা কাটাকাটি হয়। বিষয়টি ছিল একেবারেই পারিবারিক—গৃহস্থালি বিষয় নিয়ে ক্ষুদ্র বিরোধ। রাত ১টার দিকে কথার এক পর্যায়ে স্বপন রাগ করে নিজের ঘরে চলে যান এবং দরজা বন্ধ করে দেন।

তিনি আরও জানান, “আমি অনেকবার দরজা খুলতে বলেছি, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। পরে আতঙ্কিত হয়ে পাশের প্রতিবেশীদের ডাকি। সবাই মিলে দরজা ভাঙলে দেখি স্বপন গলায় ফাঁস দিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে। আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকি।”

পরে প্রতিবেশীদের সহায়তায় দ্রুত স্বপনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন রাত আড়াইটার দিকে।

পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে তথ্য

ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, “মরদেহটি হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানা পুলিশকে অবহিত করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটি আত্মহত্যা বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তবে তদন্তের পর বিষয়টি বিস্তারিত জানা যাবে।”

তিনি আরও জানান, মৃত স্বপনের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ এখনো লিখিত অভিযোগ করেননি। পুলিশ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে।

পারিবারিক অভিমানেই এমন পরিণতি?

স্বজনরা জানিয়েছেন, স্বপন ও তানিয়ার সংসার জীবন ছিল মাত্র আট মাসের। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতো ঠিকই, কিন্তু এমন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেবে—তা কেউ ভাবেনি।

স্বপনের বড় ভাই জানান, “আমার ভাই একটু আবেগপ্রবণ ছিল। সামান্য কথা নিয়েই মন খারাপ করে ফেলত। তবে সে আত্মহত্যা করবে এটা কল্পনাও করিনি।”

প্রতিবেশীদের চোখে স্বপন

প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, স্বপন ছিলেন খুবই নম্র ও পরিশ্রমী তরুণ। তিনি স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন। প্রতিদিন সকালে কাজে যেতেন এবং রাতে দেরি করে ফিরতেন। এক প্রতিবেশী বলেন, “আমরা কখনো ওর কোনো খারাপ আচরণ দেখিনি। খুব চুপচাপ মানুষ ছিল।”

সমাজে আত্মহত্যার বেড়ে চলা প্রবণতা

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, আর্থিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক চাপ ও মানসিক অস্থিরতার কারণে দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন, যা প্রতি ঘণ্টায় গড়ে দেড়জনের মৃত্যু। এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারণ হিসেবে দেখা যায়—ভালোবাসার সম্পর্কে বিচ্ছেদ, পারিবারিক কলহ, বা হতাশা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা ও পারিবারিক সহমর্মিতা বৃদ্ধি না পেলে এই প্রবণতা আরও বাড়বে।

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা হক বলেন,
“আত্মহত্যা কখনোই কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। পরিবার ও সমাজকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, মানুষ যখন অভিমান বা মানসিক চাপে ভোগে, তখন তার পাশে দাঁড়ানোই সবচেয়ে বড় সহায়তা।”

তিনি পরামর্শ দেন, সম্পর্কের ঝামেলায় যদি কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, তবে অবিলম্বে কাউন্সেলিং নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে পরিবার ও বন্ধুদের উচিত এমন পরিস্থিতিতে সহানুভূতিশীল থাকা।

আইনগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ

মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ জানায়, মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ধারণে তদন্ত চলছে। প্রয়োজন হলে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসনকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে।

পরিবারে শোকের ছায়া

স্বপনের মৃত্যুর খবরে তার গ্রামের বাড়িতে নেমে এসেছে শোকের মাতম। মা-বাবা ও ভাইবোনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে গ্রামের বাতাস। বাবা বজলু মিয়া বলেন, “আমার ছেলেটা জীবনের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। এমন সিদ্ধান্ত নেবে, এটা ভাবতে পারছি না।”

সমাজে সচেতনতার আহ্বান

বিশেষজ্ঞ ও সমাজকর্মীরা বলছেন, এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা রোধে পারিবারিক বন্ধন শক্ত করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা জরুরি। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতামূলক প্রচারণা, স্কুল-কলেজে কাউন্সেলিং সেবা চালু করা এবং সমাজে ইতিবাচক যোগাযোগ তৈরি করতে হবে।

সহায়তা প্রয়োজন হলে

বাংলাদেশে বর্তমানে মানসিক সংকটে থাকা মানুষদের জন্য বিভিন্ন সংস্থা বিনামূল্যে সহায়তা দিচ্ছে। যেমন:

  • কানেক্ট বাংলাদেশ হেল্পলাইন: 09666-787878
  • মাইন্ড এইড হাসপাতাল: 01779554391
  • কথা সেবা: 01779554391

এই সংস্থাগুলো ২৪ ঘণ্টা মানসিক সহায়তা দিয়ে থাকে। প্রয়োজন হলে যে কেউ যোগাযোগ করতে পারেন।

এক মুহূর্তের আবেগ, সামান্য রাগ কিংবা অভিমান—এসবই অনেক সময় জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্তের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মোহাম্মদপুরের স্বপন মিয়ার ঘটনাটি আমাদের আরেকবার মনে করিয়ে দেয়, জীবনের প্রতিটি সমস্যারই সমাধান আছে, কিন্তু আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।
পরিবার, বন্ধু, সমাজ—সবার দায়িত্ব হলো একে অপরের পাশে দাঁড়ানো, বোঝার চেষ্টা করা, কথা বলা। হয়তো একটু সহানুভূতিই বাঁচিয়ে দিতে পারে একটি জীবন।

MAH – 13382 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button