কর্মসংস্থান

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে কর বিভাগে ১২ বছর চাকরি!

Advertisement

মুক্তিযোদ্ধাকে ‘দাদা’ সাজিয়ে চাকরি, ১২ বছর পর ফাঁস জালিয়াতি কাণ্ড

রাজশাহীতে কর আপিল অঞ্চলের এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে—তিনি নাকি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে চাকরি নিয়েছেন এবং ১২ বছর ধরে সেই পদে বহাল রয়েছেন। অভিযুক্তের নাম মো. হিমেল কাওসার। তিনি রাজশাহী কর আপিল অঞ্চলে সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে কর্মরত ছিলেন।

সম্প্রতি রাজশাহী কর অঞ্চলের নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই অবাক করা জালিয়াতির তথ্য। শুধু তাই নয়, যে সময়ে তিনি চাকরিতে যোগ দেন, তখন মুক্তিযোদ্ধা কোটাও ছিল না—তবুও ‘অদৃশ্য প্রভাবের’ জোরে চাকরি পান তিনি।

অভিযোগের সূত্রপাত

২০২৫ সালের ২৬ আগস্ট, আব্দুল আউয়াল নামের এক ব্যক্তি লিখিতভাবে অভিযোগ করেন যে মো. হিমেল কাওসার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে চাকরি নিয়েছেন। অভিযোগ পাওয়ার পর রাজশাহী কর আপিল অঞ্চলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং তদন্তের নির্দেশ দেন।

অভিযোগে বলা হয়, হিমেল কাওসার মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিনকে (পরিচিতি নম্বর-০১৮১০০০২৬২৭, বেসামরিক গেজেট-৩৯৭) নিজের দাদা হিসেবে দেখিয়ে ২০১৩ সালের ২২ মে চাকরিতে যোগ দেন।

কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে আসে, হেমাজ উদ্দিন তার প্রকৃত দাদা নন। আসলে, হিমেলের আসল দাদা হলেন সোলাইমান শেখ, যিনি হেমাজ উদ্দিনের ভাই। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিন তার দাদার ভাই—যাকে তিনি নিজের দাদা সাজিয়ে চাকরি নিয়েছিলেন।

তদন্তে প্রকাশ পেল চাঞ্চল্যকর তথ্য

রাজশাহী কর আপিল অঞ্চলের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার আয়েশা বিনতে মিজান এই অভিযোগের তদন্ত করেন। তদন্তে তিনি নিশ্চিত হন যে হিমেল কাওসার মুক্তিযোদ্ধা সনদ জাল করে চাকরি নিয়েছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়:

“মো. হিমেল কাওসারের পিতা মো. আসির উদ্দিন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিনের পুত্র নন। উপজেলা প্রশাসন ও নির্বাচন অফিসের তথ্য অনুযায়ী হিমেলের দাদা হলেন সোলাইমান শেখ, মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিন নন।”

তদন্তে আরও উল্লেখ আছে, মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিনের চার পুত্র ও চার কন্যা সন্তান রয়েছে—জয়নাল আবেদীন, আকবর আলী, আশরাফুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, নূরজাহান, মনোয়ারা, আনোয়ারা ও নাজনীন। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই হিমেল কাওসারের পরিবারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নন।

কারণ দর্শানোর নোটিশেও নীরবতা

তদন্ত চলাকালে হিমেল কাওসারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়, যাতে তিনি তার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি, এমনকি সময় বৃদ্ধির আবেদনও করেননি। ফলে তার নীরবতাকেই দোষ স্বীকারের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

রাজশাহী কর কমিশনারের পদক্ষেপ

তদন্ত শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর রাজশাহী কর আপিল অঞ্চলের কমিশনার মুন্সী হারুনর রশিদ তদন্ত প্রতিবেদনসহ একটি চিঠি পাঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে, যেখানে হিমেল কাওসারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

তিনি বলেন:

“চাকরি বিধিতে এই ধরনের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংক্রান্ত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। তাই এনবিআরের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি।”

কোনো কোটা না থাকলেও চাকরি!

তদন্তে বেরিয়ে আসে আরও এক চমকপ্রদ তথ্য—যে সময় হিমেল কাওসার চাকরিতে যোগ দেন, তখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূর্ণ ছিল। অর্থাৎ, আর কোনো নতুন প্রার্থীকে সে কোটায় নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ ছিল না।

তারপরও তিনি কোটার সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে চাকরি পান। এই নিয়োগে তৎকালীন কর কমিশনার খন্দকার মো. ফেরদৌস আলম, যিনি পরে এনবিআরের সদস্য হিসেবে অবসরে যান, নিয়োগ বোর্ডের প্রধান ছিলেন। তার সুপারিশেই হিমেল কাওসারকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

মুক্তিযোদ্ধা সনদের অপব্যবহার: আইনি দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ

বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সনদ একটি অত্যন্ত সম্মানজনক ও সংবেদনশীল সরকারি নথি। এটি জাল করা বা ভুয়া পরিচয়ে ব্যবহার করা দণ্ডবিধির ৪৬৮ ও ৪৭১ ধারায় জালিয়াতি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

আইনজীবীদের মতে, যদি প্রমাণিত হয় যে হিমেল কাওসার ইচ্ছাকৃতভাবে ভুয়া সনদ ব্যবহার করেছেন, তবে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হওয়া উচিত।

রাজশাহীর সিনিয়র আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ বলেন:

“মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে চাকরি নেওয়া শুধু জালিয়াতিই নয়, এটি জাতির প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ। এটি দেশের সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সঙ্গে প্রতারণা।”

এনবিআরের কর্মকর্তাদের মন্তব্য

ঢাকায় এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন:

“যদি কেউ ভুয়া তথ্য দিয়ে চাকরি নেয়, তাহলে তা প্রমাণিত হলে চাকরি বাতিলের পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা হওয়া উচিত। এটি শুধু ওই ব্যক্তির অপরাধ নয়—যারা যাচাই-বাছাই না করে নিয়োগ দিয়েছেন, তারাও দায়ী।”

তিনি আরও বলেন, “চাকরি হওয়ার পরই প্রার্থীর তথ্য যাচাই করা হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হয় যাচাই হয়নি, না হয় প্রভাব খাটিয়ে তা পাশ করা হয়েছে।”

মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থার দুর্বলতা

বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটার লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার জন্য যোদ্ধাদের পরিবারকে সম্মান জানানো ও তাদের প্রজন্মকে সুযোগ দেওয়া। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কোটা দুর্নীতির এক বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

প্রতিনিয়ত শোনা যায়, ভুয়া সনদে কেউ চাকরি বা ভাতা নিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৬০০-এর বেশি ভুয়া সনদধারীর নাম বাতিল করা হয়েছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদা পারভীন বলেন:

“এই ধরনের প্রতারণা শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় করে না, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মর্যাদাকেও কলঙ্কিত করে। কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া এই প্রবণতা বন্ধ হবে না।”

হিমেল কাওসারের নীরবতা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা

হিমেল কাওসারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি। এমনকি ফোন ও লিখিত বার্তার জবাবও মেলেনি।

তবে কর বিভাগের কর্মকর্তাদের ধারণা, এনবিআর তদন্ত শেষে তার চাকরি বাতিলঅপরাধমূলক মামলা দুটোই করতে পারে।

সমাজে প্রতিক্রিয়া

রাজশাহীতে এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলছেন, “যে জাতি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়, সেখানে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরি হবে নিশ্চিত।”

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদস্য মো. আবদুল মান্নান বলেন:

“আমরা জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি, অথচ আজ আমাদের নাম ব্যবহার করে কেউ চাকরি করে। এটা জাতির জন্য লজ্জার।”

উদাহরণ তৈরি হোক সত্যের পক্ষে

এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও স্পষ্ট হলো—ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে সরকারি চাকরিতে ঢোকার প্রবণতা এখনও বন্ধ হয়নি।
যদি হিমেল কাওসারের বিরুদ্ধে প্রমাণিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে এটি ভবিষ্যতের প্রতারকদের জন্য দৃষ্টান্ত হবে।

রাষ্ট্রের উচিত হবে—

  • মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাই প্রক্রিয়া আরও কঠোর করা,
  • কোটাভিত্তিক নিয়োগে ডিজিটাল ভেরিফিকেশন চালু করা,
  • এবং যারা সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে জালিয়াতিকে সহায়তা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।

MAH – 13380 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button