ফিলিস্তিনের গাজ্জায় যুদ্ধবিরতির চুক্তি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও দখলদার ইসরাইলি বাহিনী তাদের নৃশংসতা থামায়নি। সর্বশেষ শুক্রবার (১৭ অক্টোবর ২০২৫) সন্ধ্যায় গাজ্জা শহরের পূর্বাঞ্চলীয় আল-জেইতুন এলাকায় একটি বেসামরিক গাড়িতে লক্ষ্য করে ট্যাংক থেকে গুলি চালায় ইসরাইলি সেনারা। এতে একই পরিবারের ১১ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে সাতজন শিশু ও তিনজন নারী ছিলেন।
গাজ্জার সিভিল ডিফেন্স বিভাগ জানায়, নিহত সবাই আবু শাবান পরিবারের সদস্য। তারা যুদ্ধবিরতির পর বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করছিলেন। কোনো রকম সতর্কতা বা পূর্বঘোষণা ছাড়াই ইসরাইলি বাহিনী তাদের ওপর সরাসরি গুলি চালায়।
সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, “পরিবারটি বাড়ি ফেরার পথে ছিল। ইসরাইলি সেনারা বিনা উস্কানিতে গুলি চালায়। নিহতদের মধ্যে সাত শিশু ও তিনজন নারী ছিলেন। এটি একটি ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ।”
তিনি আরও বলেন, “এই হামলা প্রমাণ করে, ইসরাইল এখনো বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করছে। যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি তাদের কাছে কোনো অর্থ বহন করে না।”
যুদ্ধবিরতির পরও অব্যাহত রক্তপাত
১১ দিন আগে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলেও, বাস্তবে গাজ্জায় তা কার্যকর হয়নি বলেই মনে করছেন স্থানীয়রা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন জানাচ্ছে, ইসরাইলি বাহিনী প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে হামলা চালাচ্ছে। কখনো ট্যাংক থেকে গোলা ছোড়া হচ্ছে, কখনো ড্রোন হামলা চলছে নিরীহ মানুষের ঘরে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, গাজ্জায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনাই আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংস্থাটি বলেছে, বেসামরিক লোকজনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা এক ধরনের যুদ্ধাপরাধ, যার জন্য দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতেই হবে।
হামাসের তীব্র নিন্দা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গাজ্জা শাসনকারী ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস এই হামলাকে ‘নৃশংস ও ঘৃণ্য অপরাধ’ বলে উল্লেখ করেছে। সংগঠনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “আবু শাবান পরিবারের ওপর ইসরাইলি হামলা ছিল পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কোনো সামরিক লক্ষ্য না থাকলেও শুধুমাত্র ফিলিস্তিনি হওয়ার অপরাধেই পুরো পরিবারটিকে হত্যা করা হয়েছে।”
হামাস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে— যুক্তরাষ্ট্রসহ সব মধ্যস্থতাকারী দেশ যেন অবিলম্বে ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে চলতে বাধ্য করে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “ইসরাইলি সেনারা সীমান্তের ইয়েলো লাইন অতিক্রম করে বেসামরিক এলাকাগুলোতে প্রবেশ করছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী এই সীমারেখা অতিক্রমের অনুমতি নেই। এটি স্পষ্টতই চুক্তি লঙ্ঘন।”
এদিকে, জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত টর ওয়েনসল্যান্ড গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “যুদ্ধবিরতি চুক্তি সত্ত্বেও বেসামরিক লোকজনের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। সকল পক্ষকে শান্তি চুক্তি বজায় রাখতে হবে।”
স্থানীয় সাংবাদিকের বর্ণনায় ভয়াবহ পরিস্থিতি
আল জাজিরার গাজ্জা প্রতিনিধি হিন্দ খুদারি জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির পরও গাজ্জার বহু মানুষ চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, “অনেকের এখনো ইন্টারনেট সংযোগ নেই। ফলে তারা জানেন না ইসরাইলি বাহিনী কোন এলাকায় অবস্থান করছে। ফলে নিরীহ পরিবারগুলো অজান্তেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রবেশ করছে এবং প্রাণ হারাচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর অনেকেই ভেবেছিলেন অন্তত কিছুটা শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে গাজ্জার আকাশে এখনো যুদ্ধবিমান ও ড্রোনের গর্জন শোনা যাচ্ছে। শিশুদের চোখে আতঙ্ক, মানুষের মুখে অনিশ্চয়তা।
নিহতদের পরিচয় ও মানবিক বিপর্যয়
স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, নিহত আবু শাবান পরিবার গাজ্জা শহরের একটি ছোট দোকান চালাত। পরিবারের কর্তা আহমেদ আবু শাবান ছিলেন এলাকার পরিচিত এক দর্জি। তিনি যুদ্ধের আগে দুই ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। হামলায় তার স্ত্রী, তিন কন্যা ও চার ছেলে নিহত হয়েছেন। পরিবারের জীবিত সদস্য এখন কেবল একজন বৃদ্ধা দাদি, যিনি হামলার সময় বাড়ির বাইরে ছিলেন।
পড়শিরা জানিয়েছেন, “তারা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ ছিল। কারও কোনো রাজনীতি ছিল না। কেবল শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু ইসরাইল তাদের সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নিল।”
হাসপাতালগুলোতে আহতদের আর্তনাদ
গাজ্জা শহরের প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র আল-শিফা হাসপাতালে এখনো আহতদের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, মৃতদের বেশিরভাগই শিশু, যাদের শরীরে ভারী বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সামির আল-খাতিব বলেন, “আমরা প্রায়ই দেখি, পুরো পরিবার একসঙ্গে আসে— কেউ মৃত, কেউ গুরুতর আহত। এমন দৃশ্য দেখা সত্যিই অসহনীয়।”
হাসপাতালের করিডোরে বসে কাঁদছিলেন এক নারী। তার স্বামী ও দুই সন্তান নিহত হয়েছে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম যুদ্ধবিরতি মানে শান্তি, কিন্তু শান্তি তো আমাদের জন্য নয়।”
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজ্জায় অবিলম্বে তদন্ত কমিটি পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে, আবু শাবান পরিবারের হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি ইসরাইলি বাহিনীর ধারাবাহিক নীতি— যেখানে বেসামরিক মানুষকেই লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে জানায়, “যুদ্ধবিরতির সময় এমন হামলা ইসরাইলের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে দেয়। তারা শান্তি নয়, সম্পূর্ণ ধ্বংস চায়।”
শিশুদের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকার
গাজ্জার শিশুদের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকার। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, গাজ্জায় চলমান সংঘাতে এক বছরেরও কম সময়ে প্রায় ১৫ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। হাজার হাজার শিশু এখনো আহত, অনেকের বাবা-মা নেই।
সংস্থার মুখপাত্র জেমস এলডার বলেন, “গাজ্জা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান শিশুদের জন্য। প্রতিদিন কোনো না কোনো শিশু মরছে, আহত হচ্ছে, কিংবা তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক নীরবতা ও ফিলিস্তিনের আহ্বান
ফিলিস্তিনি প্রশাসন বলছে, বিশ্ব এখনো কার্যকরভাবে ইসরাইলকে থামাতে ব্যর্থ। বিভিন্ন দেশ কেবল উদ্বেগ প্রকাশ করছে, কিন্তু কেউই ইসরাইলের বিরুদ্ধে অর্থবহ পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এই হামলার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করবে। তাদের বক্তব্য, “বহু দশক ধরে ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। এখন সময় এসেছে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার।”
গাজ্জার মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম
একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে অবরোধ— দুই চাপে গাজ্জার মানুষ এখন দিশেহারা। বিদ্যুৎ, পানি, খাদ্য ও ওষুধের সংকট ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে জায়গা নেই, হাজার হাজার পরিবার রাস্তায় বসবাস করছে।
৪৫ বছর বয়সী শিক্ষক ইয়াসিন হাবিব বলেন, “আমরা শুধু শান্তিতে বাঁচতে চাই। আমাদের সন্তানরা যেন স্কুলে যেতে পারে— এটাই স্বপ্ন। কিন্তু প্রতিটি দিন এখানে মৃত্যুর ভয় নিয়ে শুরু হয়।”
গাজ্জার এই সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়— এটি গোটা মানবতার প্রতি আঘাত। যুদ্ধবিরতির সময় এমন হামলা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিশ্ব যদি নীরব থাকে, তবে আরও শত শত নিরীহ প্রাণ ঝরে পড়বে এই রক্তাক্ত উপত্যকায়।
MAH – 13369 I Signalbd.com



