বাংলাদেশ

হযরত শাহজালালের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুন, নিয়ন্ত্রণে ফায়ারের ৩৬ ইউনিট

Advertisement

রাজধানী ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আজ শনিবার বিকেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৩৬টি ইউনিট দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছে। ঘটনার পর থেকে পুরো এলাকা জুড়ে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘন ধোঁয়ায় ঢেকে যায় বিমানবন্দর সংলগ্ন আকাশ।

দুপুর ২টা ৩৪ মিনিটে আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের প্রথমে নয়টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। কিন্তু আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় পরবর্তীতে একের পর এক ইউনিট যোগ হয়। শেষ পর্যন্ত মোট ৩৬টি ইউনিট একযোগে কাজ শুরু করে। পাশাপাশি উদ্ধার ও সহায়তায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এমনকি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির দুই প্লাটুনও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়।

ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তাহলা বিন জসিম জানান, “আগুন নিয়ন্ত্রণে আমাদের ৩৬টি ইউনিট কাজ করছে। এখনো আগুন লাগার সঠিক কারণ বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। এ পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবরও পাওয়া যায়নি।”

আগুনের সূত্রপাত ও সম্ভাব্য কারণ

ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক ধারণা, কার্গো ভিলেজের একটি গুদামঘরে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। গুদামগুলোতে আমদানি–রপ্তানি পণ্য, প্লাস্টিক মোড়ক, কাঠের প্যাকেট, এবং বিভিন্ন দাহ্য বস্তু সংরক্ষিত থাকায় আগুন মুহূর্তেই ভয়াবহ আকার ধারণ করে। দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি এবং বাতাসের তীব্রতার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের বেশ কয়েকটি গুদামেও।

নিয়ন্ত্রণে সম্মিলিত প্রচেষ্টা

আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিমানবাহিনীর দুটি ফায়ার ইউনিট মাঠে নামে। সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরাও তাদের নিজস্ব পানি সরবরাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে সহযোগিতা করে। ঘটনাস্থলে কয়েকটি ওয়াটার ট্যাঙ্কার সার্বক্ষণিকভাবে পানি সরবরাহ করছে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রফিকুল ইসলাম সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন,
“আগুনের তীব্রতা অনেক বেশি ছিল। আমরা পর্যায়ক্রমে আগুনের বিস্তার রোধে কাজ করেছি। আমাদের সদস্যরা এখনো ধোঁয়ার মধ্যে প্রবেশ করে হটস্পটগুলো চিহ্নিত করছেন, যাতে আগুন আবার জ্বলে না ওঠে।”

বিমান চলাচলে প্রভাব

অগ্নিকাণ্ডের কারণে বিকেল ৩টার পর থেকে বিমানবন্দরের মূল টার্মিনাল এলাকায় কিছু সময়ের জন্য বিমান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বিকল্প ব্যবস্থা নেয়। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট সাময়িকভাবে চট্টগ্রাম, সিলেট এবং কলকাতায় ডাইভার্ট করা হয়।

বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল হাসান বলেন,
“আগুন মূলত কার্গো ভিলেজ এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। যাত্রী টার্মিনালে কোনো বড় ধরনের প্রভাব পড়েনি। তবে নিরাপত্তার কারণে সাময়িকভাবে ফ্লাইট অপারেশন স্থগিত রাখা হয়। এখন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।”

ফায়ার সার্ভিসের বীরত্ব

অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আগুনের ভয়াবহ তাপ এবং ধোঁয়ার মাঝেও তারা সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ সময় ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন সদস্য ধোঁয়ার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লেও দ্রুত তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন,
“হঠাৎ দেখি আকাশ ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল আগুনের ভয়াবহতা কতটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিস এসে কাজ শুরু করে, কিন্তু আগুনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে তারা একের পর এক ইউনিট যোগ করে।”

কার্গো ভিলেজের গুরুত্ব

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ মূলত আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের সংরক্ষণ ও পরিবহন কেন্দ্র। প্রতিদিন এখান দিয়ে হাজার হাজার টন পণ্য প্রেরণ ও গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ওষুধ, পোশাক, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এবং দ্রুত নষ্ট হওয়া পণ্য যেমন ফলমূল ও ফুল।

ফলে এ এলাকায় অগ্নিকাণ্ড মানে শুধু কাঠামোগত ক্ষতি নয়, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপরও বড় প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে রপ্তানি নির্ভর পোশাক শিল্পের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা বলেন,
“এই আগুন যদি দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলে, তাহলে কোটি কোটি টাকার রপ্তানি পণ্য নষ্ট হয়ে যাবে। এর প্রভাব আমাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে পড়বে।”

সরকারের তৎপরতা ও তদন্ত কমিটি

অগ্নিকাণ্ডের পরপরই বিমান মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা আগুন লাগার কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে করণীয় নির্ধারণ করবে।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী জানান,
“আমরা ঘটনাটি খুব গুরুত্বসহকারে দেখছি। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী—সব সংস্থাই একযোগে কাজ করছে। কার্গো ভিলেজের সুরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হবে।”

ভবিষ্যৎ ঝুঁকি ও করণীয়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানবন্দরের মতো সংবেদনশীল এলাকায় এমন অগ্নিকাণ্ড নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় ঘাটতি নির্দেশ করে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে আগাম অগ্নি-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, নিয়মিত পরিদর্শন এবং দ্রুত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।

পরিবেশবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন,
“কার্গো ভিলেজের গুদামগুলোতে প্রচুর দাহ্য পদার্থ থাকে। এগুলো আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আলাদা ঝুঁকির জোনে সংরক্ষণ করা দরকার। একইসঙ্গে কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত মহড়া করা আবশ্যক।”

ঘটনাস্থলে জনগণের সহানুভূতি

ঘটনাস্থলের চারপাশে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ জড়ো হন। অনেকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের জন্য পানি, খাবার ও প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছে দেন। স্থানীয় দোকানপাট দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয় যেন কোনো বিপদ না ঘটে।

এক পথচারী বলেন,
“আমরা জীবনে এমন আগুন খুব কম দেখেছি। ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর কাজ দেখে সাহস পেয়েছি।”

প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির ধারণা

যদিও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দেওয়া হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গেছে। বিশেষ করে রপ্তানি উপযোগী তৈরি পোশাক, ওষুধ ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়েছে।

তবে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পরেই সঠিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে এই অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়—এটি দেশের অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য বড় এক সতর্কবার্তা। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ ও সব বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ক্ষয়ক্ষতি যে ব্যাপক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনা নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে—আমরা কি যথেষ্ট প্রস্তুত আমাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো রক্ষায়?

MAH – 13368 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button