
গাজার নতুন যুদ্ধ— পুনর্গঠনের লড়াই
দুই বছরের ভয়াবহ সংঘর্ষ শেষে এখন গাজা এক অন্য যুদ্ধের মুখোমুখি। এবার শত্রু গোলা-বারুদ নয়, ধ্বংসস্তূপ আর মানবিক সংকট। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজা উপত্যকা থেকে সরাতে হবে প্রায় ৫০ মিলিয়ন টন ধ্বংসাবশেষ— যা প্রায় ১৩টি মিশরের পিরামিডের সমান ওজনের। এই বিপুল ধ্বংসাবশেষ সরানোই এখন গাজার পুনর্গঠন প্রচেষ্টার প্রথম ও সবচেয়ে কঠিন ধাপ।
যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন এখনো গাজার বুকে স্পষ্ট
ইসরায়েলি সেনারা গাজা থেকে সরে গেলেও, যুদ্ধের দাগ রয়ে গেছে প্রতিটি রাস্তায়, গলিতে ও ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনে। এক সময়ের জনাকীর্ণ আবাসিক এলাকা এখন ধ্বংসস্তূপের পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। ভেঙে পড়েছে হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, এমনকি পানির লাইন ও বিদ্যুৎ সংযোগও ছিন্ন হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের স্যাটেলাইট সেন্টারের (UNOSAT) সর্বশেষ তথ্য বলছে, গাজা সিটির প্রায় ৮৩ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। শহরজুড়ে ছড়িয়ে আছে ইট, পাথর, লোহা ও ধ্বংসপ্রাপ্ত যানবাহনের ভগ্নাংশ।
স্থানীয়দের ভাষায়, গাজা এখন এক “ধ্বংসস্তূপের নগরী”।
ধ্বংসাবশেষ অপসারণ: সবচেয়ে বড় মানবিক ও লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ
গাজার পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP)। সংস্থাটির বিশেষ প্রতিনিধি জ্যাকো সিলিয়ার্স জানান, “আমাদের প্রথম কাজ হলো ধ্বংসাবশেষ সরানো। কিন্তু এটি শুধু ইট-পাথর পরিষ্কার করার কাজ নয়, বরং এটি এক বিশাল মানবিক ও নিরাপত্তাগত মিশন।”
তিনি আরও বলেন, “অসংখ্য ভবনে এখনো অবিস্ফোরিত বোমা ও গোলাবারুদ পড়ে আছে। সেগুলো পরিষ্কার না করলে ধ্বংসাবশেষ অপসারণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।”
প্রথম ধাপে রাস্তাগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে, যাতে মানবিক সহায়তা, খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী দ্রুত গাজা শহরের গভীরে পৌঁছাতে পারে। দ্বিতীয় ধাপে হাসপাতাল, পানি সরবরাহ কেন্দ্র ও সামাজিক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
মানবিক সংকট: বাসস্থান ও খাদ্যের তীব্র অভাব
যুদ্ধ শেষে গাজায় লাখো মানুষ এখন গৃহহীন। তাঁবুর নিচে চলছে তাদের দিন-রাত। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গাজায় বর্তমানে প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছে।
শীত আসন্ন। তাই সবচেয়ে বড় ভয় এখন ঠান্ডা ও বৃষ্টির মৌসুমে আশ্রয়হীন মানুষের দুর্ভোগ। ইউএনডিপি ও অন্যান্য সংস্থা ট্রানজিশনাল আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব কেন্দ্র অস্থায়ীভাবে বাসযোগ্য ঘর হিসেবে ব্যবহার করা যাবে, যতক্ষণ না স্থায়ী আবাসন তৈরি হয়।
সিলিয়ার্স বলেন, “গাজার মানুষ এখনো মানসিক ও শারীরিক আঘাতে ভুগছে। খাদ্য সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমাদের অগ্রাধিকার হলো, মানুষকে অন্তত ন্যূনতম নিরাপত্তা ও খাদ্য দিতে পারা।”
গাজার পুনর্গঠনের আর্থিক হিসাব
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, গাজা পুনর্গঠনে প্রয়োজন হবে প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্থ কেবল ভবন পুনর্নির্মাণে নয়, বরং পানি, বিদ্যুৎ, স্যানিটেশন ও চিকিৎসা সেবার পুনর্গঠনে ব্যয় হবে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “গাজার অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুনর্গঠন না হলে ফিলিস্তিনের সামগ্রিক অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই বিপুল পুনর্গঠনের অর্থ কে দেবে? আন্তর্জাতিক সহায়তা এখনো সীমিত। অনেক দেশ রাজনৈতিক কারণে দ্বিধায় রয়েছে।
অবিস্ফোরিত বোমা: নতুন বিপদের আশঙ্কা
জাতিসংঘ মাইন অ্যাকশন সার্ভিস (UNMAS) জানিয়েছে, গাজার বিভিন্ন এলাকায় লাখ লাখ অবিস্ফোরিত বোমা ও মিসাইল রয়ে গেছে। প্রতিটি ধ্বংসস্তূপের নিচে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর আশঙ্কা।
এই অস্ত্রগুলো অপসারণ না করা পর্যন্ত ধ্বংসাবশেষ সরানো ঝুঁকিপূর্ণ। তাই প্রথম ধাপে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল গাজায় প্রবেশ করছে এই বিপজ্জনক বোমাগুলো শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করতে।
মানবিক সহায়তার তীব্র প্রয়োজন
গাজার মানুষ এখন তীব্র খাদ্য ও পানি সংকটে ভুগছে। অধিকাংশ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে গেছে, বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ। হাসপাতালগুলো ওষুধ ও জ্বালানির অভাবে কার্যত অচল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল (UNHRC) বলছে, “গাজায় এখন প্রতি তিনজনের মধ্যে দুইজন পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। শিশুমৃত্যুর হার দ্রুত বাড়ছে।”
এ অবস্থায় মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে ধ্বংসস্তূপ অপসারণের কাজ দ্রুত করতে হবে। কারণ রাস্তাগুলো অবরুদ্ধ থাকলে খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সহায়তা উদ্যোগ
গাজার এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) জানিয়েছে, তারা ৩০ কোটি ইউরো মানবিক সহায়তা দেবে।
- কাতার ও তুরস্ক জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ শুরু করেছে।
- মিশর রাফাহ সীমান্ত দিয়ে সীমিত পরিসরে ত্রাণ পাঠাচ্ছে।
তবে সহায়তার গতি এখনো অনেক ধীর। বিশেষ করে সীমান্তে ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিধিনিষেধের কারণে সাহায্য পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে।
গাজার মানুষের কণ্ঠে কষ্টের গল্প
৪২ বছর বয়সী গাজার বাসিন্দা হাসান আল-খালিল বলেন, “আমার বাড়ি ছিল শহরের কেন্দ্রে। এখন সেখানে শুধু ধুলো আর ভাঙা ইট। আমি আমার পরিবারকে নিয়ে তাঁবুতে থাকছি। খাবার নেই, পানি নেই, কিন্তু বাঁচার চেষ্টা করছি।”
অন্যদিকে, ফাতেমা নূর, তিন সন্তানের মা, বলেন, “আমাদের ঘরটা ছিল ছোট, কিন্তু নিজের ছিল। এখন কিছুই নেই। শীত আসছে, আমার সন্তানদের ঠান্ডায় কাঁপতে দেখছি। আমরা শুধু চাই শান্তি আর একটা ছাদ।”
জাতিসংঘের সতর্কতা: সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেন, “গাজা এখন বিশ্বের অন্যতম বড় মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। ধ্বংসাবশেষ সরানো ও পুনর্গঠনের কাজ দ্রুত না হলে পুরো অঞ্চল আবারও অস্থির হয়ে উঠতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “মানবিক সাহায্যের প্রবাহ বাড়াতে হবে, এবং পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
ধ্বংস থেকে পুনর্জাগরণের আশা
গাজা এখন দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের এক কঠিন সন্ধিক্ষণে। যুদ্ধ শেষ হলেও লড়াই এখনো চলছে— জীবনের জন্য, ঘরবাড়ির জন্য, ভবিষ্যতের জন্য।
৫০ মিলিয়ন টন ধ্বংসাবশেষ সরানো কেবল একটি প্রকল্প নয়; এটি মানবতার এক প্রতীক। গাজার প্রতিটি ইট, প্রতিটি ধূলিকণায় আছে অসংখ্য মানুষের অশ্রু, আশা ও টিকে থাকার গল্প।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, ধৈর্য ও মানবিক ঐক্যই পারে গাজাকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে।
যুদ্ধের ছাই থেকে উঠে দাঁড়ানোর এই সংগ্রামই আজকের গাজার নতুন যুদ্ধ— পুনর্গঠনের যুদ্ধ।
MAH – 13363 I Signalbd.com