শিক্ষা

ফুটপাতে থেকেও দুই পথশিশুর শিক্ষার সংগ্রাম

Advertisement

রোদ, বৃষ্টি আর স্বপ্নের শহর

ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় প্রতিদিন ভোর হয়। সূর্যের আলোয় শহর জেগে ওঠে, শুরু হয় নতুন দিনের যাত্রা। কেউ অফিসে যায়, কেউ দোকানে, কেউ স্কুলে। কিন্তু এই শহরেই কিছু শিশু আছে যাদের কোনো ঠিকানা নেই—যাদের ঘর মানেই ফুটপাত, ছাদ মানেই খোলা আকাশ। তাদের জন্য সকাল মানে না পেট ভরে খাওয়া, বরং বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম।

তবু সেই সংগ্রামের মাঝেই কিছু শিশু আছে যারা পড়াশোনা করে, স্বপ্ন দেখে, আর বিশ্বাস করে—একদিন তারাও মানুষ হবে, নিজের জীবনের গল্প নিজের হাতে লিখবে।

এমনই দুটি শিশুর গল্প—রাজধানীর এক ফুটপাতজুড়ে বেঁচে থাকা দুটি পথশিশু, যারা অভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করেও স্কুলে যায়, বই পড়ে, আর বড় হওয়ার স্বপ্নে হার মানে না।

ফুটপাতের জীবনে সকাল: এক গ্লাস মাঠা, এক ব্যাগ স্বপ্ন

প্রতিদিন সকালে যখন শহরের বাচ্চারা স্কুলের জন্য প্রস্তুত হয়, তখন এই দুই পথশিশুর সকাল শুরু হয় ফুটপাতের ধুলো-মাটির মধ্যেই। সকালের খাবার বলতে এক গ্লাস মাঠা আর এক টুকরো শুকনো রুটি। তবু চোখেমুখে ক্লান্তি নেই, আছে আলোকিত আশা।

বয়স ৯ আর ১১—দুজনেই রাজধানীর এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। ছেঁড়া জামা, পুরনো বই, কিন্তু চোখে আগুনের মতো আলো। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তারা স্কুলে যায়। পায়ের নিচে জুতো নেই, তবু বই আঁকড়ে ধরে হাঁটে। যেন পৃথিবী জানে—তারা হাল ছাড়বে না।

“ওরা যদি কোচিং করতে পারতো, হয়তো আরও এগিয়ে যেতো”

শিশু দুটির মা বয়সে অনেক বৃদ্ধা। ভিক্ষা করে কিংবা কাগজ কুড়িয়ে যা আয় হয়, তাই দিয়েই চলে সংসার। তার কণ্ঠে ক্লান্তি আর মমতার মিশেল—
“আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই। ওরা যদি কোচিং করতে পারতো, হয়তো আগাইতো। কেউ যদি সাহায্য করতো, উপকার হতো। ওরাও তো মানুষ, ওরাও ভালো কিছু খেতে চায়। কিন্তু আমি পারি না দিতে।”

এই মা জানেন, দারিদ্র্য যেমন কষ্ট দেয়, তেমনি সন্তানদের চোখে আশা দেখলে বুক ভরে ওঠে গর্বে। তাদের জীবনে প্রতিটি দিনই নতুন যুদ্ধ।

স্কুল শেষে আবার ফুটপাতেই জীবন

দুপুর ১১টার দিকে স্কুল ছুটি হয়। অন্য বাচ্চারা যখন বাড়ি ফিরে খায়, বিশ্রাম নেয়, তখন এই দুই শিশু ফিরে আসে ফুটপাতে—তাদের একমাত্র “বাড়ি”তে। দশ ফুট প্রস্থের জায়গাটিই তাদের ঘর, বারান্দা আর খেলার মাঠ। পুরনো পলিথিন আর ইটের টুকরো দিয়ে বানানো ছোট্ট আশ্রয়ে তারা বই খোলে, খেলে, আর হাসে।

রোদে গরম হলে রাস্তার পাশের গাছের নিচে বসে। কখনও কেউ একটি পুরনো পুতুল এনে দিলে সেটাই হয় তাদের দিনের আনন্দ। জীবন যত কঠিনই হোক, তাদের হাসি যেন শহরের সব কোলাহলকে নরম করে দেয়।

শৈশবের রঙ—মেহেদি, হাসি আর স্বপ্নের খেলা

যদিও তাদের কাছে খেলনা বা পোশাক নেই, তবু শৈশবকে তারা রাঙিয়ে রাখে নিজেদের মতো করে। কখনও আঙুলে মেহেদি দেয়, কখনও চোখে কাজল লাগায়। একে অপরের মুখে হাসি ফোটায় ছোট্ট ঠাট্টায়, খুনসুটিতে।

তাদের জীবনে নেই স্মার্টফোন, নেই টেলিভিশন, তবু আছে অগাধ কল্পনা। এক শিশুর স্বপ্ন—বড় হয়ে শিক্ষক হবে। অন্যজন বলে—সে পুলিশ হতে চায়, যাতে “রাস্তায় কেউ কাঁদলে সাহায্য করতে পারে”।

ঢাকার বাস্তবতা: পঞ্চাশ হাজারের বেশি ছিন্নমূল মানুষ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু রাজধানীতেই প্রায় ৫০ হাজার ছিন্নমূল মানুষ বসবাস করছে। তাদের বড় অংশই শিশু।
আর সারা দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ লাখের মধ্যে—এমন তথ্য দিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর।

এই শিশুরা বেশিরভাগ সময়ই থাকে খোলা আকাশের নিচে। খাবার, নিরাপত্তা, শিক্ষা—সবকিছুরই অভাব। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু শিশু চেষ্টা করে নিজেদের ভাগ্য বদলাতে, যেমন এই দুই শিশু করছে।

তাদের জীবন মানেই প্রতিদিনের যুদ্ধ

দিনের বেলা রোদ, ধুলা, কোলাহল—সবকিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়। রাতে ভয় থাকে পুলিশের ধাওয়া বা বখাটে ছেলেদের উত্যক্ততা।
তবু তারা বই আঁকড়ে ধরে থাকে। বইয়ের পাতায় তারা খুঁজে নেয় নিজের পৃথিবী।

তাদের কাছে স্কুল মানে শুধু শিক্ষা নয়, একটুখানি নিরাপত্তা, একটুখানি ভালোবাসা। শিক্ষকরা তাদের নাম জানেন, মাঝে মাঝে অতিরিক্ত খাবার দেন। সেটাই তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ও সরকারি উদ্যোগ

বাংলাদেশে পথশিশুদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) জানিয়েছে, দারিদ্র্য, পারিবারিক সহিংসতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই সংখ্যা বাড়াচ্ছে।

সরকার ২০২৩ সালে “পথশিশু পুনর্বাসন প্রকল্প” চালু করেছে, যার আওতায় কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কেন্দ্রগুলো যথেষ্ট নয়।

সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, অভয়ারণ্য, এক টাকায় আহার—এরা কাজ করছে পথশিশুদের শিক্ষা ও খাদ্য নিশ্চিত করতে। তবে এখনো রাজধানীর অনেক শিশুই এই সহায়তার বাইরে।

শিক্ষার আলোই তাদের বাঁচার শক্তি

এই দুই শিশুর জীবন যেন এক জীবন্ত শিক্ষা—দারিদ্র্য কোনো বাধা নয়, যদি মনের শক্তি থাকে। তারা প্রতিদিন প্রমাণ করছে, ফুটপাতে থেকেও মানুষ বড় হতে পারে, স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।

তাদের শিক্ষক জানালেন,
“ওরা খুব মনোযোগী। বই হারিয়ে গেলেও আবার ধার নিয়ে পড়ে। এমন ছাত্র-ছাত্রী দেখলে মনে হয়, আমরাও সমাজ হিসেবে কিছু করতে পারি।”

সমাজের দায়িত্ব: শুধু সহানুভূতি নয়, কার্যকর উদ্যোগ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পথশিশুদের শুধুমাত্র দান নয়, টেকসই সহায়তা দরকার। নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার সুযোগ, পুষ্টিকর খাবার, নিরাপদ আশ্রয় ও মানসিক সহায়তা—এগুলো নিশ্চিত করতে পারলে অনেক পথশিশু সমাজের মূলধারায় ফিরতে পারবে।

তাদের ভবিষ্যৎ শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, আমাদের সবার। একজন মানুষ একটি শিশুর শিক্ষা খরচ নিলে, একদিন হয়তো সেই শিশুই সমাজকে বদলে দেবে।

ছাইয়ের নিচে আগুনের মতো স্বপ্ন

এই শহরের অসংখ্য ধূসর গল্পের ভিড়ে এই দুই শিশুর গল্পটা আলাদা।
তাদের জীবন কঠিন, কিন্তু তারা ভাঙেনি।
তারা জানে—
“জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।”

ফুটপাত তাদের ঠিকানা হলেও, তাদের স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার।
তারা হয়তো একদিন বদলে দেবে নিজেদের পৃথিবী—শুধু একটা সুযোগ পেলে।

MAH – 13362 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button