বিশ্ব

পাকিস্তানের বিমান হামলায় আফগানিস্তানে ৪০ জন নিহত

Advertisement

আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় পাকতিকা প্রদেশে পাকিস্তানের বিমান হামলায় অন্তত ৪০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন আফগান জাতীয় ক্রিকেট দলের তিনজন খেলোয়াড়। এই মর্মান্তিক ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৭০ জনের বেশি মানুষ। স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানগুলো বেসামরিক এলাকা ও ব্যস্ত বাজারে বোমা বর্ষণ করেছে, ফলে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও বিদ্যালয় ধ্বংস হয়ে গেছে।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তান পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অনুষ্ঠিতব্য ত্রিদেশীয় ক্রিকেট সিরিজ থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটি ছিল আফগানিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের মাটিতে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ত্রিদেশীয় সিরিজে অংশ নেওয়ার সুযোগ। কিন্তু দুই দেশের সামরিক উত্তেজনা ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কারণে সিরিজটি স্থগিত করা হয়েছে।

বিস্ফোরণ, মৃত্যু আর আতঙ্কে ভরা রাত

শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) মধ্যরাতে পাকিস্তানি বিমানগুলো আফগান সীমান্তের ভেতরে একাধিক স্থানে বোমাবর্ষণ শুরু করে। পাকতিকা প্রদেশের বারমাল ও গিয়ান জেলায় এই হামলার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সময় রাত প্রায় ২টার দিকে প্রথম বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়, এরপর একের পর এক বিমান হামলায় গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে।

স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুল্লাহ জানান,

“আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম, হঠাৎ ভয়ংকর শব্দে ঘর কেঁপে উঠল। সবাই চিৎকার করছিল। যখন বাইরে এলাম, দেখলাম আমাদের পুরো গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।”

দুর্ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে আছে ধ্বংসস্তূপ, পুড়ে যাওয়া যানবাহন ও ভাঙা ঘরের টুকরো। জাতিসংঘের আফগান শাখা (UNAMA) জানায়, নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

আফগান সরকারের তীব্র নিন্দা

আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্দুল নাফি তাকোর এক বিবৃতিতে বলেন,

“পাকিস্তান আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। এই হামলা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। আমরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এর ন্যায়বিচার দাবি করছি।”

তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগান সরকার একে ‘সার্বভৌমত্বের স্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসলামাবাদের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে

পাকিস্তানের দাবি ও পাল্টা যুক্তি

অন্যদিকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা “সন্ত্রাসী গোষ্ঠী টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান)”-এর ঘাঁটিতে লক্ষ্যভিত্তিক হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র জেনারেল আহমেদ শরিফ জানিয়েছেন,

“আমরা শুধু সীমান্তবর্তী এলাকায় সক্রিয় জঙ্গিদের টার্গেট করেছি, বেসামরিক এলাকাকে নয়।”

তবে স্থানীয় বাসিন্দা ও আফগান কর্মকর্তারা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলছেন, হামলার শিকার হয়েছেন নিরীহ সাধারণ মানুষ, শিশু ও নারী। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইতিমধ্যে এ হামলার স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: উদ্বেগ ও নিন্দা

এই বিমান হামলার ঘটনায় জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইরান গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন,

“যে কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব ও সীমান্ত অমান্য করা গুরুতর অপরাধ। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের উচিত সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা নিরসন করা।”

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন,

“আমরা চাই না দক্ষিণ এশিয়া আবার নতুন করে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ুক। উভয় দেশকে সংযত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।”

খেলাধুলায় কূটনীতির ছায়া: বাতিল হলো ত্রিদেশীয় সিরিজ

এই হামলার পরপরই আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (ACB) তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক ও এক্স (টুইটার) অ্যাকাউন্টে এক বিবৃতি প্রকাশ করে জানায় যে, পাকিস্তানের সঙ্গে নির্ধারিত ত্রিদেশীয় সিরিজে অংশ নিচ্ছে না আফগানিস্তান

বিবৃতিতে বলা হয়,

“আমাদের খেলোয়াড়, কোচ ও নাগরিকদের নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে পাকিস্তানে খেলতে যাওয়া সম্ভব নয়।”

এই ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক বলেছেন, রাজনীতি ও যুদ্ধের কারণে খেলাধুলা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা ক্রীড়ার ভাবমূর্তির জন্য ভালো নয়।

পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (PCB) বিষয়টি নিয়ে আফগান ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে, তবে বর্তমানে সব কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।

আফগান ক্রিকেটে শোকের ছায়া

আফগানিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বিমান হামলায় জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা নিহত হলেন। নিহত তিন ক্রিকেটারের মধ্যে দুইজন ছিলেন আফগান প্রিমিয়ার লিগে খেলোয়াড় হিসেবে সক্রিয়। দেশজুড়ে ক্রিকেটপ্রেমীরা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

আফগান অলরাউন্ডার রশিদ খান এক্স-এ (টুইটার) লিখেছেন—

“আজ আমরা শুধু সহযোদ্ধা নয়, ভাইদের হারিয়েছি। যুদ্ধ কখনো সমাধান নয়, এটি শুধু বেদনা বাড়ায়।”

পাকিস্তান-আফগান সম্পর্কের ইতিহাস: উত্তেজনার শিকড় পুরনো

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক বহুদিন ধরেই জটিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর থেকেই সীমান্তবর্তী দুরান্দ লাইন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান অভিযোগ করছে, আফগান সীমান্তে টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) আশ্রয় পাচ্ছে এবং পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে। অন্যদিকে আফগানিস্তান বলছে, পাকিস্তান তাদের সীমান্তে বারবার বিমান হামলা চালিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করছে।

২০২৩ সালে খোস্ত ও কুনার প্রদেশে পাকিস্তানের ড্রোন হামলায় অন্তত ২১ জন নিহত হয়েছিলেন। ২০২৪ সালেও সীমান্তে একাধিক সংঘর্ষ ঘটে।

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. রুহুল আমিন মনে করেন,

“দুই দেশের মধ্যে যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের দেয়াল তৈরি হয়েছে, তা এখন এক বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। যদি দ্রুত কূটনৈতিক সমাধান না হয়, তবে পুরো দক্ষিণ এশিয়া নতুন এক নিরাপত্তা সংকটে পড়তে পারে।”

তিনি আরও বলেন,

“খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক বিনিময় ছিল দুই দেশের সম্পর্কের সেতুবন্ধন। এখন সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”

মানবিক সংকট ও ভবিষ্যৎ আশঙ্কা

জাতিসংঘের হিসেবে, সাম্প্রতিক এই হামলায় অন্তত ৩০০ পরিবারের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে আহতদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে চিকিৎসকরা। ওষুধ, রক্ত ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক রেড ক্রস (ICRC) বলছে, আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সংস্থাটি জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা সহায়তা পাঠিয়েছে পাকতিকা প্রদেশে।

আন্তর্জাতিক সংলাপের আহ্বান

বিশ্ব শান্তিরক্ষা সংস্থা ও ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (OIC) উভয় দেশকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে, যুদ্ধ নয়, শান্তিপূর্ণ আলোচনা-ই একমাত্র সমাধান হতে পারে।

আফগানিস্তান ও পাকিস্তান—দুই দেশই যুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে। সীমান্তের প্রতিটি গোলাগুলি নতুন করে জন্ম দিচ্ছে শোক, ক্ষোভ ও প্রতিশোধের আগুন। এই বিমান হামলা শুধু প্রাণহানি ঘটায়নি, বরং দুই মুসলিম প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ককে আরও গভীর সংকটে ফেলেছে

বিশ্ব যখন শান্তির পথে এগোতে চায়, তখন এমন হামলা মানবতার জন্য এক অশনি সংকেত।

MAH – 13357 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button