
নারীর স্বাধীনতা নাকি ধর্মীয় বৈষম্য? ইউরোপজুড়ে নতুন বিতর্কের জন্ম
পর্তুগালের পার্লামেন্টে সম্প্রতি একটি বিতর্কিত বিল পাস হয়েছে, যেখানে জনসমক্ষে মুখ ঢেকে রাখা বা নিকাব পরা নারীদের জন্য কঠোর জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। শুক্রবার পাস হওয়া এই বিল অনুযায়ী, কেউ জনসমক্ষে নিকাব বা মুখ ঢাকা কোনো পোশাক পরলে তাকে ২০০ থেকে ৪,০০০ ইউরো পর্যন্ত জরিমানা দিতে হতে পারে।
বিলটিতে আরও বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো নারীকে নিকাব পরতে বাধ্য করে, তার জন্য সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
তবে এই নিষেধাজ্ঞা সব জায়গায় প্রযোজ্য নয়। উড়োজাহাজে ভ্রমণের সময়, কূটনৈতিক ভবন এবং ধর্মীয় উপাসনালয়ে মুখ ঢেকে রাখা যাবে।
বিলের পেছনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এই বিলটি প্রস্তাব করেন পর্তুগালের কট্টর ডানপন্থি রাজনৈতিক দল “চেগা” (Chega)-এর নেতা আন্দ্রে ভেনচুরা। তার দাবি, “এই বিল নারীর মুক্তি এবং দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।”
পার্লামেন্টে বিলটি পাস হয় মধ্য-ডানপন্থি জোটের সমর্থনে, যদিও বামপন্থি ও উদারবাদী দলগুলো এর বিরোধিতা করে।
চেগা দলের নেতা ভেনচুরা বলেন—
“আজ আমরা আমাদের মেয়েদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করেছি। আমরা চাই না আমাদের দেশে কেউ ধর্ম বা সংস্কৃতির নামে নারীদের মুখ ঢেকে রাখুক।”
অন্যদিকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (ক্ষমতাসীন দল)-এর নারী সংসদ সদস্য আন্দ্রেয়া নেতো বলেন,
“এটি নারী ও পুরুষের সমতা রক্ষার আইন। কোনো নারীকে তার মুখ ঢাকতে বাধ্য করা উচিত নয়।”
তবে অনেকের মতে, এই বক্তব্যের আড়ালে মুসলিম নারীদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।
সংসদে বিরোধিতা ও ভোটের ফলাফল
বিলের ওপর ভোটাভুটিতে দশটি দলের মধ্যে দুটি দল ভোটদানে বিরত ছিল।
এই দুটি দল হলো—
- People–Animals–Nature Party (PAN)
- Together for the People Party (JPP)
তাদের মতে, “এই বিল বৈষম্যকে উসকে দেয় এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী।”
বামপন্থি নারীনেত্রীরাও বিলের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তারা বলেন, এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এক ধরনের আইনি বৈষম্য এবং নারীর পোশাকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।
ইউরোপে নিকাব নিষিদ্ধের ইতিহাস
পর্তুগালের আগে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে নিকাব বা বোরকা নিষিদ্ধ করেছে।
যেমন—
- ফ্রান্স: ২০১০ সালে প্রথম দেশ হিসেবে জনসমক্ষে মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করে।
- বেলজিয়াম: ২০১১ সালে একই ধরনের আইন চালু হয়।
- নেদারল্যান্ডস: ২০১৯ সালে আংশিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে।
- অস্ট্রিয়া: ২০১৭ সালে নিকাব নিষিদ্ধ করে।
এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো পর্তুগাল, যদি প্রেসিডেন্ট মার্সেলো রেবেলো ডি সুজা এই বিলটিকে অনুমোদন দেন।
তিনি চাইলে বিলটিতে ভেটো দিতে পারেন বা সাংবিধানিক আদালতে পাঠাতে পারেন পর্যালোচনার জন্য।
মুসলিম নারীদের প্রতিক্রিয়া: “এটি আমাদের বিশ্বাসের ওপর আঘাত”
পর্তুগালে মুসলিম জনসংখ্যা খুবই সীমিত—মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশেরও কম।
তবু এই আইনকে তারা দেখছেন ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ হিসেবে।
লিসবনের এক মুসলিম নারী বলেন—
“আমি কখনো কাউকে আমার নিকাব পরার জন্য বাধ্য করিনি। এটা আমার বিশ্বাস ও পরিচয়ের অংশ। এখন সরকার সেটাকে অপরাধ বানাচ্ছে।”
আরেকজন শিক্ষার্থী জানান—
“আমরা নিরাপত্তা বা নারী অধিকারের নামে আমাদের পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা দেখছি। এটি গণতান্ত্রিক নয়।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উভয়েই এই বিলের সমালোচনা করেছে।
তাদের মতে,
“এমন আইন নারীদের রক্ষা করে না, বরং তাদের জনজীবন থেকে দূরে ঠেলে দেয়।”
তারা আরও যুক্তি দেয় যে, মুসলিম নারীরা এখন ভয় বা সামাজিক লজ্জার কারণে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মক্ষেত্রে যেতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলও পূর্বে জানিয়েছিল—
“মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করা আসলে স্বাধীনতা সীমিত করা, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে অসঙ্গত।”
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ: নিরাপত্তা নাকি রাজনৈতিক কৌশল?
ইউরোপের রাজনীতিবিদদের মতে, এই বিলটি নিরাপত্তা ও নারী স্বাধীনতা রক্ষার নামে রাজনৈতিক ভোটব্যাংক লক্ষ্য করে আনা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক কার্লোস ফ্রেইরা বলেন—
“নিকাব নিষিদ্ধের মাধ্যমে ডানপন্থি দলগুলো মূলত ভোটারদের আবেগে আঘাত করছে। বাস্তবে এই বিলের সামাজিক প্রভাব খুবই সীমিত হবে, কারণ পর্তুগালে নিকাব পরা নারীর সংখ্যা নগণ্য।”
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে—
“এটি কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নয়; বরং সমাজে উন্মুক্ত যোগাযোগ ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয়।”
ধর্মীয় স্বাধীনতা বনাম জাতীয় নিরাপত্তা: দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে ইউরোপ
গত এক দশক ধরে ইউরোপে ইসলামোফোবিয়া এবং ধর্মীয় পোশাক নিয়ে বিতর্ক বেড়েই চলেছে।
অনেকেই মনে করেন, এই ধরনের আইন আসলে মুসলিম নারীকে “অন্য” হিসেবে চিহ্নিত করে।
বিশেষ করে ফ্রান্স, জার্মানি, ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডে মুসলিম নারীরা প্রায়ই কর্মক্ষেত্র বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছে—
“ইউরোপে ধর্মীয় সহনশীলতা ও বহুত্ববাদ দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। এখন পর্তুগালের এই সিদ্ধান্ত সেই আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়েছে।”
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
যদিও আইনটি সরাসরি অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা,
এই সিদ্ধান্ত পর্যটন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে পর্যটক আগমনে হ্রাস ঘটতে পারে।
এছাড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভবিষ্যতের প্রশ্ন: স্বাধীনতা কার, সংরক্ষণ কাদের?
এই বিলটি এখন প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের অপেক্ষায়।
তিনি যদি অনুমোদন দেন, তাহলে আইনটি কার্যকর হতে আর সময় লাগবে না।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—
এটি কি সত্যিই নারীর স্বাধীনতা রক্ষা করছে,
নাকি একটি সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের নতুন রূপ?
বিশ্বজুড়ে আজ এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।
পর্তুগালের এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র একটি আইনি পদক্ষেপ নয়—
এটি ইউরোপে চলমান ধর্মীয় স্বাধীনতা, নারী অধিকার ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের লড়াইয়ের আরেকটি অধ্যায়।
যে মহাদেশ একসময় “স্বাধীনতা, সমতা ও মানবাধিকারের” প্রতীক ছিল,
সেখানেই এখন পোশাক হয়ে উঠছে রাজনৈতিক অস্ত্র।
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মী ও সাধারণ মানুষ একটাই প্রশ্ন তুলছে—
“নারী যদি স্বাধীন হয়, তবে তার পোশাক বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা কোথায়?”
MAH – 13353 I Signalbd.com