বিশ্ব

৪৮ ঘণ্টার অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত আফগানিস্তান ও পাকিস্তান

Advertisement

সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর দুই দেশের শান্তি আলোচনায় নতুন সম্ভাবনা

দীর্ঘ উত্তেজনা ও সীমান্ত সংঘর্ষের পর অবশেষে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দুই প্রতিবেশী মুসলিম দেশ— ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানপাকিস্তান— ৪৮ ঘণ্টার জন্য একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে দুই দেশের মধ্যে চলমান সহিংসতা আপাতত থেমে গেলেও, উত্তেজনা এখনো পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি।

যুদ্ধবিরতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা

বুধবার (১৫ অক্টোবর) পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়,

“কাবুল ও ইসলামাবাদ উভয় পক্ষই আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত পরিস্থিতির সমাধান খুঁজতে আগ্রহী। এজন্য পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে আমরা ৪৮ ঘণ্টার জন্য যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছি।”

এই যুদ্ধবিরতি পাকিস্তান সময় সন্ধ্যা ৬টা (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টা) থেকে কার্যকর হয়েছে বলে জানা গেছে।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই সময়ে উভয় দেশ তাদের সামরিক বাহিনীকে সীমান্তে আক্রমণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে এবং মানবিক সহায়তা ও আহতদের উদ্ধারে কাজ করবে।

সংঘর্ষের সূত্রপাত ও পুনরায় যুদ্ধের সূচনা

সংবাদ সংস্থা রয়টার্সটোলোনিউজ জানায়, সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যস্থতায় সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে দুই দেশ একটি অস্থায়ী চুক্তিতে পৌঁছেছিল।
কিন্তু মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায়, মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাত থেকে সীমান্তে আবারও গোলাগুলি ও ভারী অস্ত্রের লড়াই শুরু হয়।

সংঘর্ষটি মূলত আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশের স্পিন বোলদাক সীমান্ত ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের চামান জেলা সংলগ্ন এলাকায় ঘটে।
সীমান্তের এই অঞ্চলটি বহুদিন ধরেই উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার বিকাল পর্যন্ত সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। এতে দুই পক্ষেই ডজনাধিক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
আফগান গণমাধ্যমের দাবি, পাকিস্তানি গোলাবর্ষণে বেশ কয়েকটি গ্রাম ও বেসামরিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দুই দেশের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

আফগানিস্তানের দাবি

আফগান সরকারের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ এক্স (পূর্বের টুইটার)-এ পোস্ট দিয়ে জানান,

“মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তান প্রথমে আমাদের সীমান্তে ভারী ও মাঝারি অস্ত্র ব্যবহার করে হামলা শুরু করে। এতে কয়েকজন নিরীহ আফগান নাগরিক নিহত হন, যা যুদ্ধবিরতি চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন।”

তিনি আরও বলেন,

“পাকিস্তানের হামলায় অন্তত ১২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং প্রায় ১০০ জন আহত হয়েছেন। আফগান সেনারা আত্মরক্ষায় পাল্টা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকটি চৌকি ও স্থাপনা ধ্বংস করেছে।”

আফগান পক্ষের দাবি অনুযায়ী, তারা পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু ট্যাংক ও অস্ত্র জব্দ করেছে এবং সীমান্ত এলাকায় “অবৈধ প্রবেশ” ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

অন্যদিকে পাকিস্তান সরকারের দাবি, আফগান সেনারাই প্রথমে সংঘর্ষ উস্কে দেয়
পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়,

“মঙ্গলবার বিকেলে আফগান সেনারা চামান সীমান্তে আমাদের তিনটি সামরিক চৌকিতে গুলিবর্ষণ করে। আত্মরক্ষার জন্যই পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে।”

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জানায়, আফগানিস্তানের হামলায় ৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়েছেন।

সংঘর্ষের পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনার ইতিহাস নতুন নয়।
১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্ধারিত ডুরান্ড লাইন (Durand Line) আজও দুই দেশের মধ্যে বিতর্কের মূল কারণ।

আফগানিস্তান এই সীমান্তরেখাকে “অবৈধ ও চাপিয়ে দেওয়া” বলে মনে করে,
অন্যদিকে পাকিস্তান এটিকে বৈধ আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে দেখে।
ফলে সীমান্তজুড়ে প্রায়ই সামরিক সংঘর্ষ, অবৈধ অনুপ্রবেশবাণিজ্যিক অচলাবস্থা দেখা যায়।

২০২৩ ও ২০২৪ সালেও সীমান্তে একাধিক সংঘর্ষে উভয় দেশের শতাধিক সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়।
বিশেষত ২০২4 সালের আগস্টে চামান সীমান্তে সংঘর্ষের পর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে।

সৌদি-কাতারের মধ্যস্থতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

সাম্প্রতিক এই যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সৌদি আরব ও কাতারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
দুই দেশই উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে ফেরাতে পর্দার আড়ালে কাজ করে যাচ্ছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে দুই দেশের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেন,

“যুদ্ধবিরতি মানবিক সহায়তা ও শান্তি আলোচনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করবে।”

এছাড়াও, চীনতুরস্ক দুই দেশকেই সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
চীন জানিয়েছে, “আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কূটনৈতিক সমাধানই একমাত্র পথ।”

মানবিক সংকট ও সীমান্তের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ

সীমান্তের দুই পাশে থাকা সাধারণ মানুষই সংঘর্ষের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।
চামান ও স্পিন বোলদাকের হাজারো পরিবার গত কয়েকদিন ধরে বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মুহাম্মদ ইয়াকুব জানান,

“আমরা প্রতিদিনই গোলাগুলির আওয়াজ শুনি। শিশুরা আতঙ্কে ঘুমাতে পারে না। দোকানপাট বন্ধ, বাজারে খাবারও মিলছে না।”

আফগানিস্তান সরকারের মানবিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে, সীমান্ত এলাকায় খাদ্য, ওষুধ ও পানির তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘের অনুমান অনুযায়ী, চলমান সংঘর্ষে প্রায় ১৫,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত: “এই যুদ্ধ কারও জন্যই লাভজনক নয়”

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি উভয় দেশের অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতার জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে।

ইসলামাবাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পাক ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজ (PIPS)–এর গবেষক আহমেদ রশিদ বলেন,

“দুই দেশই অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্বের সংকটে ভুগছে। এই মুহূর্তে যুদ্ধ নয়, কূটনৈতিক সমঝোতাই উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক।”

তিনি আরও বলেন, “যুদ্ধবিরতি যদি কার্যকর থাকে, তাহলে এটি ভবিষ্যতে একটি স্থায়ী শান্তি আলোচনার ভিত্তি তৈরি করতে পারে।”

আগামীর পথ: স্থায়ী সমাধান সম্ভব?

৪৮ ঘণ্টার এই অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর উভয় দেশ নতুন করে শান্তি আলোচনায় বসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইসলামাবাদ ও কাবুলে আগামী সপ্তাহে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আয়োজন হতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সীমান্তে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দুই দেশকে পারস্পরিক বিশ্বাস, বাণিজ্য সহযোগিতা এবং সন্ত্রাসবিরোধী তথ্য বিনিময়ের ওপর জোর দিতে হবে।

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক বহুদিন ধরেই উত্তেজনাপূর্ণ।
তবে ২০২৫ সালের এই যুদ্ধবিরতি হয়তো নতুন এক কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে।
যদি দুই দেশ সত্যিই সংযম ও আলোচনার পথে থাকে, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

MAH – 13339 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button