
বিশ্বখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান জনসন অ্যান্ড জনসন (Johnson & Johnson)–এর জনপ্রিয় বেবি পাউডার নিয়ে ফের নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে হাজারো মামলা দায়ের হয়েছে। অভিযোগ—তাদের ট্যালকম পাউডারে অ্যাসবেস্টস (Asbestos) নামক এক ধরনের ক্ষতিকর খনিজ পদার্থ রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
এই অভিযোগ নতুন নয়। গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন আদালতে এই কোম্পানির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। এবার যুক্তরাজ্যের আদালতে প্রায় তিন হাজার ভুক্তভোগী একসঙ্গে মামলা দায়ের করেছেন, যা এখন বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
মামলার মূল অভিযোগ
বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা গেছে, মামলার নথিতে জনসন অ্যান্ড জনসনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে যে, ১৯৬০-এর দশক থেকেই কোম্পানিটি জানত তাদের ট্যালকম পাউডারে কিছু ফাইবার-সমৃদ্ধ খনিজ উপাদান, যেমন ট্রেমোলাইট (Tremolite) ও অ্যাকটিনোলাইট (Actinolite) রয়েছে।
এই দুটি খনিজ ফাইবার আকারে থাকলে সেগুলো অ্যাসবেস্টস নামে পরিচিত হয়—যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রাণঘাতী ক্যানসার (Mesothelioma, Ovarian Cancer)-এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত বলে প্রমাণিত।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ঝুঁকি জানা সত্ত্বেও কোম্পানিটি তাদের পণ্যের প্যাকেটে কখনো কোনো সতর্কবার্তা দেয়নি। বরং তারা তাদের বেবি পাউডারকে “বিশুদ্ধতা ও নিরাপত্তার প্রতীক” হিসেবে প্রচার করেছে, যা বিজ্ঞাপন ও বিপণন নীতির মারাত্মক অপব্যবহার হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রমাণ ও নথি
বিবিসি জানিয়েছে, মামলার প্রমাণ হিসেবে কিছু অভ্যন্তরীণ নথি, ল্যাব রিপোর্ট, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং ইমেইল যোগাযোগ আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। এসব নথি থেকে ধারণা পাওয়া গেছে যে, কোম্পানির গবেষক ও ব্যবস্থাপনা পর্যায় দীর্ঘদিন ধরে জানতেন ট্যালকম পাউডারে ক্ষতিকর উপাদান আছে, তবুও তারা ব্যবসায়িক স্বার্থে তা গোপন রাখেন।
মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সায়েন্স (NIEHS)-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “অ্যাসবেস্টস কণার দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শে থাকা শরীরের কোষে পরিবর্তন ঘটাতে পারে, যা ক্যানসার সৃষ্টি করে।”
ট্যালকম পাউডার কীভাবে ঝুঁকিপূর্ণ?
ট্যালকম পাউডার তৈরি হয় ট্যালক (Talc) নামক এক ধরনের খনিজ থেকে, যা প্রাকৃতিকভাবে মাটিতে অ্যাসবেস্টসের কাছাকাছি অবস্থান করে। ফলে কখনও কখনও ট্যালক সংগ্রহের সময় তাতে অ্যাসবেস্টস মিশে যেতে পারে।
অ্যাসবেস্টসের কণাগুলো এত ক্ষুদ্র যে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে বা ত্বকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ করে, যারা দীর্ঘ সময় ধরে বেবি পাউডার ব্যবহার করেন—তাদের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয় ক্যানসার বা ফুসফুসের রোগ হওয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায় বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা
অনেক নারী অভিযোগ করেছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে জনসন অ্যান্ড জনসনের বেবি পাউডার ব্যবহার করেছেন এবং পরে ডিম্বাশয় ক্যানসার ধরা পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের আদালতে ২০২১ সালে ২২ জন নারী জনসনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। আদালত কোম্পানিটিকে ২.১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে রায় দেন, যদিও পরবর্তীতে কোম্পানি আপিল করে।
যুক্তরাজ্যের ভুক্তভোগীরা বলছেন, “আমরা বিশ্বাস করেছিলাম এটি নিরাপদ। এটি আমাদের বাচ্চাদের জন্য ছিল। কিন্তু এখন জেনে আমরা স্তম্ভিত—যে পণ্যটিকে আমরা ভালোবাসতাম, সেটিই আমাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে।”
জনসন অ্যান্ড জনসনের প্রতিক্রিয়া
অবশ্য, কোম্পানিটি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। জনসন অ্যান্ড জনসনের এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন,
“আমাদের বেবি পাউডার শতভাগ নিরাপদ। এতে কোনো অ্যাসবেস্টস নেই এবং এটি ক্যানসার সৃষ্টি করে না। প্রতিটি উৎপাদন ধাপ কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সম্পন্ন হয়।”
তারা আরও দাবি করেছে, অতীতে যেসব গবেষণায় ঝুঁকির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, সেগুলোর বেশিরভাগই অসম্পূর্ণ বা বিভ্রান্তিকর তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে মামলা ও ক্ষতিপূরণ
বিভিন্ন দেশে জনসন অ্যান্ড জনসনের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের হয়েছে।
- শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ৪০,০০০-এরও বেশি মামলা এখনো বিচারাধীন।
- কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের কয়েকটি দেশেও নতুন মামলা গ্রহণ করা হয়েছে।
- কোম্পানিটি ইতিমধ্যে কয়েকটি মামলায় বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছে।
২০২৩ সালে তারা ঘোষণা দেয় যে, ভবিষ্যতে ট্যালক-ভিত্তিক পাউডার উৎপাদন বন্ধ করে কর্নস্টার্চ-ভিত্তিক পাউডারে রূপান্তর করবে। তবে, বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি দেরিতে নেওয়া সিদ্ধান্ত—যখন ইতিমধ্যেই বহু মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
বিজ্ঞানীরা কী বলছেন?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার (IARC)–এর গবেষণায় দেখা গেছে, ট্যালকম পাউডার সরাসরি নয়, তবে অ্যাসবেস্টস-দূষিত ট্যালক ব্যবহার করলে ক্যানসারের ঝুঁকি স্পষ্টভাবে বেড়ে যায়।
এছাড়া, ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া-এর গবেষক ড. লিসা ব্রাউন বলেন,
“ট্যালকম পাউডার যদি নিখুঁতভাবে বিশুদ্ধ হয়, তবে তা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু বাস্তবে ট্যালকের খনিজ উৎসে অ্যাসবেস্টস থাকা প্রায় অনিবার্য, তাই এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।”
বাজারে প্রভাব ও অর্থনৈতিক দিক
এই মামলাগুলির প্রভাব কোম্পানির আর্থিক অবস্থার ওপরও পড়েছে। ২০২৫ সালের শুরুতে জনসন অ্যান্ড জনসনের বাজারমূল্য প্রায় ১২% কমে যায়, যা তাদের শেয়ারহোল্ডারদের জন্য বড় ধাক্কা ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের মামলার কারণে কোম্পানিগুলোর প্রতি ভোক্তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের ব্র্যান্ড ইমেজের জন্য ক্ষতিকর।
সাধারণ মানুষের করণীয়
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—
- শিশুর ত্বকে ট্যালক পাউডার ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করুন।
- যদি ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে কর্নস্টার্চ-ভিত্তিক পাউডার বেছে নিন।
- পাউডার ব্যবহারের সময় বাচ্চার মুখ, নাক ও চোখে যাতে না লাগে, তা নিশ্চিত করুন।
- দীর্ঘমেয়াদি ত্বকের জ্বালা বা শ্বাসকষ্ট হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
জনসন অ্যান্ড জনসনের মতো একটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ নিঃসন্দেহে বিশ্বজুড়ে ভোক্তা সুরক্ষা এবং কর্পোরেট দায়বদ্ধতার প্রশ্ন নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখনই সময়—কোম্পানিগুলোর উচিত তাদের পণ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং মানুষের স্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, যে পণ্য একসময় “নিরাপত্তার প্রতীক” হিসেবে খ্যাত ছিল, তা যেন আর কারও জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে না আনে।
MAH – 13336 I Signalbd.com