
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে ৭৫৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪২ জনে, আর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৭ হাজারেরও বেশি মানুষ।
ডেঙ্গুতে আবারও প্রাণহানি, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে
এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু পরিস্থিতি দেশে আবারও উদ্বেগজনক আকার ধারণ করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) নতুন করে ৭৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন আরও চারজন।
এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২৪২ জনে। আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ৫৭ হাজার ১৫ জনে।
ঢাকায় সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৭৫৮ জন রোগীর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছেন সবচেয়ে বেশি ২০২ জন। ঢাকার বাইরে ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ভর্তি হয়েছেন আরও ১৫৮ জন।
এছাড়া বরিশাল বিভাগে ১৩৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৫ জন, খুলনা বিভাগে ৬২ জন, ময়মনসিংহে ৫০ জন, রাজশাহীতে ৪৭ জন, রংপুরে ১৯ জন এবং সিলেট বিভাগে ভর্তি হয়েছেন ২ জন।
এতে দেখা যাচ্ছে, এখনো রাজধানী ও আশপাশের এলাকাগুলোই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
ডেঙ্গুতে মৃতদের পরিসংখ্যান
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৪২ জন, যার মধ্যে ১২৮ জন পুরুষ ও ১১৪ জন নারী।
মৃতদের মধ্যে অধিকাংশই ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী। চিকিৎসকরা বলছেন, এই বয়সী মানুষদেরই কর্মজীবী হওয়ায় তারা বাইরে বেশি সময় থাকেন এবং মশার সংস্পর্শে বেশি আসেন।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া চারজনের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়—ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে। অন্যজন মারা গেছেন বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলার পাথরঘাটায়।
বয়সভিত্তিক আক্রান্তের হার ও লিঙ্গভিত্তিক তুলনা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন করে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশই পুরুষ।
তাদের মতে, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা। এই বয়সীদের মধ্যে অসচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহাই সংক্রমণ বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাছাড়া গ্রীষ্মের দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টি ও অপর্যাপ্ত মশা নিধন কর্মসূচি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
সেপ্টেম্বরেই ছিল সর্বোচ্চ সংক্রমণ, অক্টোবরেও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা
ডেঙ্গু সংক্রমণ সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেশি দেখা যায়। তবে চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে রেকর্ডসংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অক্টোবরের প্রথমার্ধেও সংক্রমণের হার কমেনি বরং নতুন সংক্রমণ প্রতিদিনই কয়েকশত হচ্ছে।
এ অবস্থায় তারা মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ঘাটতি এবং সচেতনতার অভাবকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা ও পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর সংক্রমণ রোধে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে না পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাহবুবুল হক বলেন, “এখনো অনেক পরিবার ডেঙ্গুর প্রাথমিক উপসর্গকে হালকাভাবে নিচ্ছে। এতে রোগীর অবস্থা দ্রুত জটিল হয়ে পড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “ডেঙ্গুর চিকিৎসায় সময়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই জ্বর, শরীর ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা বা বমি হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।”
অন্যদিকে, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সিটি করপোরেশনগুলোর মশা নিধন কার্যক্রমে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।
তাদের দাবি, বৃষ্টির মৌসুমে লার্ভা ধ্বংসে নিয়মিত তদারকি না থাকায় এডিস মশার প্রজনন অব্যাহত রয়েছে।
নাগরিক সচেতনতা ও প্রতিরোধই মূল সমাধান
ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞরা নাগরিকদের অংশগ্রহণকেই সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হিসেবে দেখছেন।
বাড়ির ছাদে, ফুলের টবে, এসির নিচে বা ফ্রিজের ট্রেতে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এছাড়া শিশু ও বয়স্কদের মশারি ব্যবহার, মশা নিরোধক লোশন ও পোশাকে সতর্কতা অবলম্বন করাও জরুরি।
সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষও যদি প্রতিদিন ১০ মিনিট সময় দিয়ে নিজের আশপাশের পানি ফেলে দিতে পারেন, তাহলে সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
চলতি বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে, তবু ক্রমবর্ধমান রোগীসংখ্যা চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যৌথভাবে কাজ না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
সচেতনতা, পরিচ্ছন্নতা ও সময়মতো চিকিৎসাই হতে পারে ডেঙ্গু মোকাবিলার একমাত্র উপায়।
এম আর এম – ১৭৮৭,Signalbd.com