
রাজধানীর মিরপুর শিয়ালবাড়িতে গতকাল মঙ্গলবার ভয়াবহ আগুনে পুড়ে নিহতদের মধ্যে ১০ জনের লাশ স্বজনদের দাবি অনুযায়ী শনাক্ত হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে লাশগুলো রাখা হয়েছে এবং সিআইডি তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করছে, যাতে ভবিষ্যতে শনাক্তকরণে কোনো সমস্যা না হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “সবগুলো লাশের চেহারা দগ্ধ হওয়ার কারণে বিকৃত হয়েছে। তবে স্বজনেরা ১০টি লাশ শনাক্তের দাবি করেছেন। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে এই লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সমস্ত লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা না হয়।”
আগুনের ঘটনা ও বিস্তার
মিরপুর শিয়ালবাড়ির ৩ নম্বর সড়কে অবস্থিত টিনশেডের রাসায়নিক গুদামে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আগুন লাগে। আগুনের তীব্রতায় গুদামে বিস্ফোরণ ঘটে, যা পাশের চারতলা ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে চারতলা ভবনের দোতলা ও তিনতলার বিভিন্ন স্থান থেকে ১৬টি লাশ উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধারকৃত লাশগুলো গতকাল সন্ধ্যার পর ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। হাসপাতালের পরিচালক জানিয়েছেন, নিহতদের মধ্যে নয়জন পুরুষ এবং সাতজন নারী। জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা লাশগুলো স্বজনেরা চাইলে, পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের অনুমতি পেলে ময়নাতদন্ত ছাড়া হস্তান্তর করা সম্ভব।
ভবনের অবস্থা ও অগ্নিনিরাপত্তার ঘাটতি
স্থানীয় ও সরকারী সূত্রে জানা যায়, আগুন লাগা ভবনটি মূলত চারতলা হলেও ছাদের উপর অতিরিক্ত একটি টিনশেডের তলা তৈরি করা হয়েছিল। ভবনের দোতলায় ‘স্মার্ট প্রিন্টিং’ নামে একটি টি-শার্ট প্রিন্ট কারখানা এবং তিন ও চারতলায় ‘আরএন ফ্যাশন’ নামে একটি পোশাক কারখানা চলছিল।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, আগুন লাগার সময় ভবন ও গুদামে কোনো ধরনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা বা ফায়ার সেফটি লাইসেন্স ছিল না। এছাড়া, ভবনের ছাদের দরজাগুলোও তালাবদ্ধ ছিল। আগুন লাগার পর সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া ধোঁয়া ও গ্যাসে স্থানটি আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
উদ্ধারকাজ ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ
ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নেভাতে গিয়ে বিশেষ পোশাক পরে ঢুকেছেন গুদামে। তবে রাসায়নিক গুদামের বিস্ফোরণ ও ‘বিষাক্ত গ্যাস’ ছড়িয়ে পড়ার কারণে উদ্ধারকাজে জটিলতা দেখা দেয়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভবনের আশেপাশের এলাকায় আগুন ও ধোঁয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট, চোখে জল আসা এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “বিস্ফোরণ ও আগুনের তীব্রতার কারণে কেবল দমকলকর্মীরাই সরাসরি ঢুকতে পারছেন। সাধারণ মানুষ বা স্বজনরা সেখানে যেতে পারছে না।”
নিহতদের পরিবার ও স্বজনদের প্রতিক্রিয়া
নিহতদের স্বজনরা জানিয়েছেন, “আমরা চাই আমাদের লাশ শনাক্ত হয়ে দ্রুত আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হোক। এই ঘটনায় আমাদের পরিবার অত্যন্ত ভেঙে গেছে। প্রশাসন যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।”
প্রসঙ্গত, আগুনে মৃতদের মধ্যে বয়সের দিক দিয়ে সবাই কর্মজীবী, এবং অধিকাংশই ওই কারখানার শ্রমিক ছিলেন। অনেক পরিবার জানাচ্ছে, “নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবেই এমন দূর্ঘটনা ঘটেছে। শ্রমিকরা নিয়মিত লাইসেন্সবিহীন এবং অগ্নিনিরাপত্তাহীন ভবনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।”
আগুনের কারণ ও তদন্ত
প্রাথমিকভাবে পুলিশের অনুমান, আগুন লাগার মূল কারণ হতে পারে রাসায়নিক গুদামে সংরক্ষিত দ্রব্যের অনিয়ন্ত্রিত সঞ্চালন ও বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। তবে ফায়ার সার্ভিস এবং সিআইডি যৌথভাবে তদন্ত শুরু করেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে, “আমরা গুদামের মালিক, কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছি। তদন্তের মাধ্যমে আগুন লাগার প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করা হবে। এছাড়া ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
দেশের বিভিন্ন অংশে আগুন দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে আগুন লাগার ঘটনা নতুন কিছু নয়। রাজধানী ঢাকার পোশাক কারখানা, গুদাম বা বাজারে প্রায়ই অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষত, লাইসেন্সবিহীন কারখানা, অগ্নিনিরাপত্তাহীন ভবন ও ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ মূল কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
- ২০১২ সালের তাজরীন ফ্যাশন কারখানার আগুনে ১০০+ শ্রমিক নিহত হয়েছিল।
- ২০১৯ সালে নারায়ণগঞ্জের রাসায়নিক গুদামে আগুনে ২০+ মানুষ প্রাণ হারায়।
এ ধরনের ঘটনায় স্বজনরা সবসময় ক্ষুব্ধ এবং দাবি করেন সরকার যেন কারখানা ও গুদামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করে।
ফায়ার সার্ভিস ও সরকারের প্রতিক্রিয়া
ফায়ার সার্ভিসের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জানিয়েছেন, “সতর্কতা, লাইসেন্স এবং অগ্নিনিরাপত্তা মানদণ্ড মানা হলে এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমরা সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। ভবিষ্যতে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আহত ও নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ভবনের মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয়দের সচেতনতা ও নিরাপত্তা নির্দেশিকা
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভবনের চারপাশে আগুন লাগার পর চিৎকার ও ভিড় সৃষ্টি হয়েছিল। তবে, কিছু মানুষ নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ, আগুন নেভানোর যন্ত্র, সঠিক লাইসেন্স এবং ত্রুটিমুক্ত বৈদ্যুতিক সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া, গুদামে রাসায়নিক সংরক্ষণে নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। এটি ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর হবে।”
মিরপুর শিয়ালবাড়ির এই ভয়াবহ আগুন আমাদের দেশের শ্রমিক নিরাপত্তা, অগ্নিনিরাপত্তা এবং অপ্রতিষ্ঠিত কারখানার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। মৃতদের পরিবার ও স্বজনরা এখন শোকের ছায়ায়, তবে সঠিক তদন্ত ও সতর্ক ব্যবস্থা আগামীতে এমন দুর্ঘটনা কমাতে সহায়ক হবে।
নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করি এবং তাদের পরিবারকে সমবেদনা জানাই। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ ও সচেতনতা ছাড়া ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়।
MAH – 13323 I Signalbd.com