বিশ্ব

চলন্ত বাসে ভয়াবহ আগুন: রাজস্থানে পুড়ে ছাই ২০ যাত্রী, আহত ১৫

Advertisement

জয়সালমীর-যোধপুর মহাসড়কে মুহূর্তে আগুনে পরিণত হলো যাত্রীবাহী বাস

ভারতের রাজস্থান রাজ্যের জয়সালমীর থেকে যোধপুরগামী একটি যাত্রীবাহী বাসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ২০ জন আরোহী পুড়ে মৃত্যু বরণ করেছেন। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জয়সালমীর-যোধপুর জাতীয় মহাসড়কে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া আরও অন্তত ১৫ জন গুরুতর আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে চারজন নারী ও দুটি শিশু রয়েছে।

ঘটনাটি ঘটার পর মুহূর্তেই পুরো বাস আগুনে পুড়ে যায়, এবং অনেক যাত্রী জানালা ভেঙে বা দরজা খুলে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। স্থানীয়রা ছুটে এসে উদ্ধার কাজে অংশ নেন, কিন্তু আগুনের তীব্রতায় কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো বাসটি ছাই হয়ে যায়।

চালকের দ্রুততা বাঁচালো বহু প্রাণ

পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বাসটি মোট ৫৭ জন যাত্রী নিয়ে জয়সালমীর থেকে যোধপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। যাত্রা শুরুর প্রায় আধঘণ্টা পর বাসটির পেছনের দিক থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়।
চালক সঙ্গে সঙ্গে বাসটি রাস্তার পাশে থামিয়ে দেন এবং যাত্রীদের নামার নির্দেশ দেন। কিন্তু তখনই জ্বালানি ট্যাংকের কাছে বিস্ফোরণ ঘটে এবং মুহূর্তেই আগুন পুরো গাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে।

চালকের বুদ্ধিমত্তায় অন্তত ২০-২৫ জন যাত্রী দ্রুত বের হতে পারেন, তবে বাকিরা আটকা পড়ে যান আগুনের ভেতরে।

স্থানীয়দের বীরত্ব ও উদ্ধার অভিযান

দুর্ঘটনার পর স্থানীয় গ্রামবাসী ও পথচারীরা আগুনের ভেতর থেকে যাত্রীদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগলেও স্থানীয়দের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে অন্তত কয়েকজন যাত্রীর জীবন রক্ষা পায়।

ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বাসটির বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বাসটি মাত্র পাঁচ দিন আগে নতুন করে কেনা হয়েছিল এবং এটি বেসরকারি ট্রাভেল কোম্পানি শ্রীসাই ট্রাভেলস পরিচালনা করছিল।

গুরুতর আহতদের গ্রিন করিডর দিয়ে যোধপুরে স্থানান্তর

গুরুতর দগ্ধ ১৫ আরোহীকে প্রথমে জয়সালমীরের জওহর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
তাদের মধ্যে কয়েকজনের দেহের ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের যোধপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে পুলিশ ন্যাশনাল হাইওয়ে ১২৫-এ গ্রিন করিডর তৈরি করে। ফলে আটটি অ্যাম্বুলেন্স কোনো বাধা ছাড়াই মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যে আহতদের যোধপুরে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়।

প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর শোক, ক্ষতিপূরণ ঘোষণা

রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ভজন লাল শর্মা দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রাতেই জয়সালমীর পৌঁছে পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন এবং আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান।
তিনি বলেন,

“এটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। নিহতদের পরিবারের পাশে রাজ্য সরকার আছে। দ্রুততম সময়ে তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করা হবে।”

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মৃতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২ লাখ রুপি এবং আহতদের ৫০ হাজার রুপি করে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।

চোখের সামনে মৃত্যু দেখলেন যাত্রীরা

বেঁচে ফেরা এক যাত্রী গণমাধ্যমকে বলেন,

“আগুন লেগে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পুরো বাস জ্বলতে শুরু করে। আমরা জানালা ভেঙে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। কিন্তু অনেকে বের হতে পারেননি। তাদের চিৎকার এখনো কানে বাজছে।”

অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন,

“চালক সাহসিকতার সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে সবাইকে নামতে বলেন, কিন্তু আগুনের তীব্রতায় কিছুই করার সুযোগ ছিল না। কয়েকজনকে আমরা নিজের হাতে টেনে বের করেছি।”

বাসটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত, দেহ শনাক্তে চ্যালেঞ্জ

জয়সালমীরের জেলা কালেক্টর প্রতাপ সিং জানিয়েছেন,

“আগুনে বাসটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে। অধিকাংশ দেহ পুড়ে চেনা যাচ্ছে না। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।”

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বাসটি ডিলাক্স কোচ, যাতে এসি ইউনিট ও বৈদ্যুতিক সংযোগ নতুনভাবে বসানো হয়েছিল। শর্টসার্কিট ওই এসি ইউনিট থেকেই শুরু হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

তদন্তে বিশেষ দল গঠন

রাজস্থান সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনাটির কারণ অনুসন্ধানে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই কমিটি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট জমা দেবে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন।

প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, বাসটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথাযথ ছিল না। ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা জরুরি এক্সিট দরজা কার্যকর অবস্থায় ছিল না।

এছাড়া ট্রাভেল কোম্পানির কাছে যাত্রী নিরাপত্তা মানদণ্ড মেনে চলার কোনো সার্টিফিকেট ছিল না বলেও জানা গেছে।

ভারতে বাস দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র

ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১.৫ লাখ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ বাস দুর্ঘটনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুরনো যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, চালকের ক্লান্তি, ও নিরাপত্তা মান রক্ষায় উদাসীনতা এই দুর্ঘটনাগুলোর মূল কারণ।

রাজস্থানে শুধু চলতি বছরেই ২০০-রও বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮০০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে সরকারি পরিসংখ্যানে উল্লেখ আছে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের আহ্বান

এই দুর্ঘটনার পর পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষ রাজ্য সরকারের কাছে বাস পরিবহনে কঠোর নিরাপত্তা নীতি প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন।
বিশেষ করে নতুন কেনা বাসগুলোর ইলেকট্রিক সার্কিট ও ফায়ার সেফটি চেক বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হচ্ছে।

এছাড়া জরুরি অবস্থায় যাত্রীদের বের হতে সাহায্য করার জন্য অটো এক্সিট সিস্টেম চালুর পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

MAH – 13317 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button