
দুই বছরের ইসরায়েলি হামলায় গাজার শতাব্দী প্রাচীন মসজিদ ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। ১,২৪৪টি মসজিদের মধ্যে ৮৩৫টি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস এবং ১৮০টি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় দীর্ঘ দুই বছরের ইসরায়েলি হামলায় বহু ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থাপনাকে ধ্বংসের মুখে পড়তে হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপত্যকার মোট ১,২৪৪টি মসজিদের মধ্যে ৮৩৫টি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে, এবং আরও ১৮০টি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংসের শিকার মসজিদগুলোর মধ্যে অনেকটাই মামলুক ও উসমানীয় আমলে নির্মিত, যা গাজার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ।
মসজিদ ও ধর্মীয় স্থাপনার ব্যাপক ধ্বংস
সাম্প্রতিক হামলায় গাজার প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ মসজিদগুলোও রক্ষা পায়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন মসজিদ ছিল প্রায় ১৪০০ বছর পুরনো মহান ওমরী মসজিদ, যা ‘ছোট আল-আকসা’ নামে পরিচিত। এটি একসময় ৫ হাজার বর্গমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং ফিলিস্তিনের তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলায় এটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।
অন্য গুরুত্বপূর্ণ মসজিদগুলোর মধ্যে রয়েছে সাইয়্যিদ হাশিম মসজিদ, যা ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর বিমান হামলায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। একইভাবে মামলুক আমলে নির্মিত কাতিব আল-ওয়ালায়া মসজিদও ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর ধ্বংস হয়। চতুর্দশ শতকের ইবনে উসমান মসজিদ, আলী ইবনে মারওয়ান মসজিদ এবং ১৩৬১ সালে নির্মিত জাফার আদ-দিমরী মসজিদও বর্তমানে কেবল ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ গাজার ১৯২৮ সালে নির্মিত গ্রেট খান ইউনিস মসজিদও ধ্বংস হয়েছে।
হামলার ধারা
গাজা উপত্যকায় দীর্ঘ দুই বছরের ইসরায়েলি হামলা চলাকালীন সময়ে বাসস্থান, স্কুল, হাসপাতাল এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। এই হামলায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে ৬৭,৫০০-এর বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। যদিও সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে, তবুও উপত্যকার অধিকাংশ এলাকা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত।
ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদগুলো কেবল উপাসনার স্থান ছিল না; এটি গাজার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসরায়েলি হামলা এই ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
মানবিক ও সামাজিক প্রভাব
এই হামলায় স্থানীয় জনগণ অসহায় অবস্থায় পড়েছে। ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংসের ফলে ফিলিস্তিনের মানুষদের সংস্কৃতিগত ও মানসিক ক্ষতি অমোচনীয়। স্থানীয়রা জানান, “মসজিদ আমাদের উপাসনার স্থান, কিন্তু পাশাপাশি আমাদের ইতিহাস ও পরিচয়ের প্রতীকও। এগুলো ধ্বংস হওয়ায় আমরা শূন্যতায় পড়ে গিয়েছি।”
শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মীরা জানিয়েছেন, ধর্মীয় স্থাপনার ধ্বংস শুধু উপাসনার জায়গা হারানো নয়; এটি শিক্ষার, ইতিহাসের এবং সামাজিক ঐতিহ্যের অপূরণীয় ক্ষতি।
বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “গাজার মসজিদ ও ঐতিহাসিক স্থাপনার ধ্বংস ফিলিস্তিনের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি করেছে। এই ক্ষতি পুনরুদ্ধার করা কঠিন।”
কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলের এই হামলার নিন্দা জানিয়ে সতর্ক করেছে, “ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করলে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হয়। এটি শুধুমাত্র ফিলিস্তিন নয়, মানবজাতির জন্যও একটি বড় ক্ষতি।”
পরিসংখ্যান ও তুলনা
- মোট মসজিদ: ১,২৪৪টি
- সম্পূর্ণ ধ্বংস: ৮৩৫টি
- আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত: ১৮০টি
- প্রাণহানি: ৬৭,৫০০-এর বেশি
- প্রাচীনতম মসজিদ: মহান ওমরী মসজিদ, প্রায় ১৪০০ বছর পুরনো
এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে যে, ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা কতটা বিস্তৃত ও ভয়াবহ।
গাজার ৮৩৫টি মসজিদ ধ্বংস হওয়া শুধু ফিলিস্তিন নয়, পুরো বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ধর্ম, ইতিহাস ও সংস্কৃতির জন্য এই ক্ষতি প্রায়ই অপূরণীয়। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দায়িত্ব বাড়ছে—এটি প্রতিহত করা, সাহায্য প্রদান এবং ভবিষ্যতে পুনঃনির্মাণে সহায়তা করা।
এদিকে, গাজার মানুষের জন্য অচলাবস্থা ও নিরাপত্তাহীনতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কতদিন ধরে এই ক্ষয়ক্ষতি চলবে এবং বিশ্ব সম্প্রদায় কবে বাস্তব পদক্ষেপ নেবে?
এম আর এম – ১৭৭৯,Signalbd.com