
রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর এলাকায় একটি প্রিন্টিং কারখানা ও সংলগ্ন কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস জানায়, মঙ্গলবার দুপুরে শুরু হওয়া এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতে সময় লাগে প্রায় ছয় ঘণ্টা। নিহতদের বেশিরভাগই কারখানার শ্রমিক, যারা বের হতে না পেরে ভবনের ভেতরেই প্রাণ হারিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ধ্বংসস্তূপ থেকে একে একে মরদেহগুলো উদ্ধার করা হচ্ছে। “টিনশেড ছাদ বন্ধ থাকায় অনেকে বের হতে পারেননি,” বলেন তিনি। মরদেহগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। শনাক্তের জন্য ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন হবে বলে জানান তিনি।
আগুন লাগার সময় ও কারণ
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দের পরপরই ভবন থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো কারখানা ও পাশের কেমিক্যাল গোডাউনে। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট প্রথমে ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করে; পরে আরও পাঁচটি ইউনিট যোগ দেয়।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, রাসায়নিক পদার্থ থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণেই আগুনের সূত্রপাত। ভবনের একাংশে রাখা ছিল হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, ব্লিচিং পাউডার ও প্লাস্টিক দ্রব্য, যা আগুনের গতি বাড়িয়ে দেয়।
উদ্ধারকাজ ও তল্লাশি অভিযান
দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে কারখানা অংশের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে কেমিক্যাল গোডাউনের অংশটি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপে আরও মরদেহ থাকতে পারে। সেজন্য ড্রোন ও থার্মাল স্ক্যানার প্রযুক্তি ব্যবহার করে তল্লাশি অভিযান চলছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, “ভবনের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ায় উদ্ধারকাজে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। আমরা প্রতিটি ঘর স্ক্যান করছি, যাতে কোনো নিখোঁজ ব্যক্তি পড়ে না থাকে।”
উদ্ধারকাজে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা সহায়তা করছেন। আশপাশের এলাকায় সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় আগুনের ভয়াবহতা
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, “একটা বড় বিস্ফোরণের শব্দের পরপরই ভবনের জানালা ভেঙে আগুন বের হতে দেখি। মুহূর্তের মধ্যেই ধোঁয়ায় চারদিক ঢেকে যায়।”
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রুবিনা আক্তার বলেন, “আমার ভাই ওই কারখানায় কাজ করত। ফোনে কথা বলার সময় হঠাৎ লাইন কেটে যায়। এরপর থেকে আর কোনো খবর পাইনি।”
ঘটনাস্থলে স্বজনদের আহাজারিতে শোকার্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। অনেকে হাসপাতাল ও স্কুলে খোঁজ নিচ্ছেন প্রিয়জনের কোনো খোঁজ মেলে কি না।
আহতদের অবস্থা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১১ জন দগ্ধ রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ রোগী শ্বাসকষ্ট ও বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. সামিউল ইসলাম বলেন, “অনেকে বিষাক্ত ধোঁয়া শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন। সময়মতো অক্সিজেন না পেলে অবস্থার অবনতি হতে পারে।”
ঢাকা জেলা প্রশাসন নিহতদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। আহতদের চিকিৎসা ব্যয়ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বহন করা হবে।
নিরাপত্তা ঘাটতি ও কেমিক্যাল ঝুঁকি
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, ভবনটি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে বিপজ্জনক কেমিক্যাল মজুত ছিল। পূর্বে কোনো লাইসেন্স বা নিরাপত্তা ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছিল কি না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কেমিক্যাল গুদাম রাখা একটি স্থায়ী বিপদ। টঙ্গী, চকবাজার ও সিদ্দিকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এনামুল হক বলেন, “প্রতিবারই তদন্ত হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। যতদিন এসব গুদাম আবাসিক এলাকায় থাকবে, ততদিন এ ধরনের মৃত্যুঝুঁকি থেকেই যাবে।”
প্রশাসনের পদক্ষেপ ও তদন্ত কমিটি
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ও জেলা প্রশাসক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসক জানান, আগুনের কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
মেয়র বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর কথা বলছি। এখন সময় এসেছে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার। মানুষের জীবন যেন আর এভাবে শেষ না হয়।”
পুনরাবৃত্ত দুর্ঘটনা ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন
রাজধানীতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিবারই তদন্ত কমিটি হয়, ক্ষতিপূরণ ঘোষণা আসে, তারপর সব কিছু আগের জায়গায় ফিরে যায়।
মিরপুরের এই অগ্নিকাণ্ড আবারও মনে করিয়ে দিল—নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি, অনুমোদনহীন গোডাউন ও কেমিক্যাল সংরক্ষণের নিয়ম না মানা এখনো বড় হুমকি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ ও স্থায়ী সমাধান। অন্যথায়, ভবিষ্যতের মিরপুর বা চকবাজারের আগুন কেবল সময়ের অপেক্ষা।
এম আর এম – ১৭৭৫,Signalbd.com