
প্রিন্টিং কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রাজধানী কাঁপল; এখনও নিখোঁজ কয়েকজন, ফায়ার সার্ভিসের তল্লাশি চলছে
রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর এলাকায় একটি প্রিন্টিং কারখানা ও সংলগ্ন কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে শুরু হওয়া আগুন সন্ধ্যা নাগাদ আংশিক নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে রাসায়নিক পদার্থ থাকায় এখনো আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও নিখোঁজ থাকতে পারে। তাদের সন্ধানে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
আগুন লাগার সময় ও প্রাথমিক তথ্য
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম জানান, দুপুর ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন লাগার খবর পান তারা। খবর পেয়ে প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে, পরে আরও ১২টি ইউনিট যুক্ত হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ডিরেক্টর তাজুল ইসলাম বলেন, “এটি একটি অত্যন্ত জটিল আগুন। গোডাউনে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল থাকার কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত।”
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কেমিক্যালের সংস্পর্শে তৈরি হওয়া বিষাক্ত গ্যাসের কারণেই মৃত্যুগুলো ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রিন্টিং কারখানার শ্রমিক ছিলেন, যারা আগুন লাগার সময় ভবনের ভেতরেই কাজ করছিলেন।
ফায়ার সার্ভিসের তল্লাশি ও উদ্ধার অভিযান
ফায়ার সার্ভিসের ডিরেক্টর তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পরও তারা এখনো ডিফেন্সিভ কৌশলে কাজ করছেন। আশপাশে থাকা কেমিক্যালের কারণে আগুন যে কোনো সময় পুনরায় ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, “আমরা ড্রোন ও আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে তল্লাশি চালাচ্ছি। ভবনের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই উদ্ধারকাজে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।”
তল্লাশি অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরাও যোগ দিয়েছেন। নিখোঁজদের স্বজনরা স্থানীয় স্কুল ও হাসপাতালে ভিড় করছেন, অনেকেই এখনও প্রিয়জনের কোনো খোঁজ পাননি।
নিহত ও আহতদের পরিচয়
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজনের নাম জানা গেছে—মো. সুরুজ (৩০), মো. মামুন (৩৫) ও সোহেল (৩২)। তারা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দগ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অনেকেই শ্বাসকষ্ট ও বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়েছেন। নিহতদের মরদেহ শনাক্তের পর পুলিশের মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।
স্থানীয়দের বর্ণনায় ভয়াবহতা
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, “হঠাৎ বিকট শব্দ হয়, তারপর ধোঁয়া বের হতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো ভবন আগুনে ঘিরে যায়।”
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রুবিনা আক্তার বলেন, “আমার ভাই ওই কারখানায় কাজ করত। খবর পেয়ে এসে দেখি চারপাশে আগুন আর ধোঁয়া। এখনও ওর কোনো খোঁজ পাইনি।”
স্বজনদের কান্না, আগুনের ধোঁয়া আর ধ্বংসস্তূপের চিত্রে মিরপুর এলাকা পরিণত হয়েছে শোকার্ত পরিবেশে।
আগুনের উৎস ও রাসায়নিক ঝুঁকি
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ঘটনাস্থলের কেমিক্যাল গোডাউনে ব্লিচিং পাউডার, প্লাস্টিক ও হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডসহ অন্তত ছয় থেকে সাত ধরনের রাসায়নিক ছিল। এসব দাহ্য পদার্থ আগুনের গতি ও তীব্রতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
ডিরেক্টর তাজুল ইসলাম বলেন, “এই রাসায়নিকগুলো টঙ্গীর কেমিক্যাল কারখানার মতোই বিপজ্জনক। ঠিক কোন রাসায়নিক থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব গুদাম সাধারণ আবাসিক এলাকায় রাখাই একটি বড় ভুল। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কেমিক্যাল মজুত থাকলে যে কোনো দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।
উদ্ধারকাজে চ্যালেঞ্জ ও প্রযুক্তির ব্যবহার
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও তল্লাশিতে এবার প্রথমবারের মতো উন্নত তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্র (থার্মাল স্ক্যানার) ও ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবিত বা মৃত কাউকে শনাক্ত করা সহজ হচ্ছে।
অন্যদিকে, বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে যাতে নতুন কোনো বিস্ফোরণ না ঘটে। ভবনের আশপাশে জনসাধারণের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পূর্বের অগ্নিকাণ্ড ও নিরাপত্তা প্রশ্নে উদ্বেগ
রাজধানীর টঙ্গী, চকবাজার ও সিদ্দিকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর একাধিকবার কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদাম সরানোর নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় বারবার এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, “প্রতিবারই তদন্ত কমিটি হয়, রিপোর্টও দেওয়া হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। যতদিন পর্যন্ত আবাসিক এলাকায় এ ধরনের গোডাউন থাকবে, ততদিন এই বিপদ থেকে রক্ষা সম্ভব নয়।”
প্রশাসনের পদক্ষেপ ও তদন্ত
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ঢাকা জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনায় ৫০ হাজার টাকা করে তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়া হবে।
এছাড়া পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা সাত দিনের মধ্যে আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণ প্রতিবেদন দেবে।
মিরপুরের অগ্নিকাণ্ড আবারও প্রমাণ করল, রাজধানীর শিল্প ও আবাসিক এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি এখনো ভয়াবহ। নিখোঁজদের সন্ধানে অভিযান চলছে, কিন্তু নিহতদের পরিবারের আহাজারি রাজধানীবাসীর বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন একটাই—প্রতিবারের মতো কি এবারও তদন্তের পর সব ভুলে যাওয়া হবে, নাকি এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজধানীকে নিরাপদ করা হবে?
এম আর এম – ১৭৭৩,Signalbd.com