
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুরিদকে শহরে ইসরাইলবিরোধী এক সমাবেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একজন পুলিশ কর্মকর্তা, তিনজন বিক্ষোভকারী এবং একজন সাধারণ পথচারী রয়েছেন বলে দেশটির পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
ইসরাইলবিরোধী পদযাত্রা থেকে সংঘর্ষে রণক্ষেত্র
স্থানীয় সময় সোমবার দুপুরে লাহোর থেকে ইসলামাবাদমুখী তেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান (টিএলপি)-এর সমর্থকরা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে পদযাত্রা শুরু করলে পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রোডে কয়েক ঘণ্টা ধরে টানা সংঘর্ষ চলে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের।
পুলিশ জানায়, বিক্ষোভকারীরা প্রথমে রাস্তায় ব্যারিকেড দিলে এবং পুলিশের অভিযানে বাধা দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে উভয় পক্ষই একে অপরের দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা গুলি চালালে পুলিশেরও পাল্টা গুলি চলে।
মুরিদকে শহরের বিভিন্ন স্থানে ৪০টিরও বেশি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, ভাঙচুর করা হয় সরকারি ভবন ও যানবাহন। সংঘর্ষের সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম।
তেহরিক-ই-লাবাইকের দাবি, “পুলিশই আগে গুলি চালিয়েছে”
ইসলামপন্থী দল টিএলপি অভিযোগ করেছে, পুলিশ প্রথম গুলি চালানোয় তাদের বেশ কয়েকজন সমর্থক নিহত হয়েছেন। দলটির নেতা সাদ রিজভি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে জানানো হয়; তার শরীরে তিনটি গুলির ক্ষত রয়েছে বলে দাবি করেছে সংগঠনটি।
রিজভি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমাদের কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানানো এবং ইসরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো।” তিনি আরও বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ মিছিল করছিলাম, কিন্তু পুলিশ বিনা উসকানিতে হামলা চালায়।”
গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরেও উত্তেজনা
এই বিক্ষোভ এমন সময় হচ্ছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়েছে। তবুও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে নানা ধরনের প্রতিবাদ চলছে।
টিএলপি জানায়, এই পদযাত্রা ছিল গাজায় ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদে এবং “ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্ব মুসলিমদের ঐক্যের আহ্বান” জানানোর উদ্দেশ্যে।
পুলিশের পাল্টা বক্তব্য
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে, কিন্তু বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ওপর গুলি চালানো শুরু করলে বাধ্য হয়ে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে হয়।
পাঞ্জাব প্রাদেশিক পুলিশের এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা চাইনি কেউ আহত বা নিহত হোক, কিন্তু তারা অস্ত্র ব্যবহার করায় আমাদেরও আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালাতে হয়।” তিনি আরও জানান, সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন এবং ডজনখানেক বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে।
সহিংস আন্দোলনের পুরোনো ইতিহাস
তেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান এর আগেও সহিংস বিক্ষোভের জন্য খবরের শিরোনাম হয়েছে। নবী মুহাম্মদ (সা.)–কে অবমাননার অভিযোগে আগের সরকারগুলোর বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন বহুবার সংঘর্ষে রূপ নেয়। ২০২১ সালে দলটি একইভাবে লাহোরে বিশাল বিক্ষোভের আয়োজন করেছিল, যা পরবর্তীতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, টিএলপি এখন পাকিস্তানের ইসলামপন্থী রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয়েছে, এবং তাদের কর্মকাণ্ড দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ উদ্বেগ
ঘটনার পর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলছেন, ধর্মীয় ইস্যুতে এমন সহিংস আন্দোলন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
অন্যদিকে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের সমালোচনা করেছে। তবে পাকিস্তান সরকার এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজা যুদ্ধের পর মুসলিম বিশ্বজুড়ে যে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে, পাকিস্তানের এই ঘটনাও তারই প্রতিফলন। তবে এমন সংঘর্ষ দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। এখন দেখার বিষয়, সরকার কীভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং টিএলপি কীভাবে তাদের আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নেয়।
এম আর এম – ১৭৫১,Signalbd.com