
বাংলাদেশ সরকারের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন অবশেষে বাস্তবে রূপ নিল। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজারের বিমানবন্দরকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। এই ঘোষণা শুধু কক্সবাজার নয়, পুরো বাংলাদেশের পর্যটন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে।
সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি
গতকাল রোববার (১২ অক্টোবর ২০২৫) বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিএ-১ শাখা থেকে এ সংক্রান্ত একটি সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনটিতে স্বাক্ষর করেন যুগ্মসচিব আহমেদ জামিল। সোমবার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়—
“Sub-rule (1)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার The Civil Aviation Rules, 1984 এর Rule 16 অনুযায়ী কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে ঘোষণা করল।”
এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, জনস্বার্থে জারি করা এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর: কী পরিবর্তন আনবে?
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে কক্সবাজার এখন থেকে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলো। বর্তমানে ঢাকা (হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর), চট্টগ্রাম (শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর), ও সিলেট (ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
নতুন এই সংযোজনের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে কক্সবাজার, টেকনাফ, বান্দরবান, রামু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক পর্যটন ও অর্থনীতিতে সম্ভাবনার বিস্তার
বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলোর মধ্যে কক্সবাজারের নাম বহু আগেই উঠে এসেছে। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত ছাড়াও এখানে রয়েছে পাহাড়, ঝরনা, দ্বীপ ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর অঞ্চল।
কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা সরাসরি এখানে পৌঁছাতে পারবেন। এখন পর্যন্ত বিদেশি পর্যটকদের ঢাকায় নামার পর আবার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে কক্সবাজার যেতে হয়। এতে সময় ও খরচ—দুটিই বেশি হয়।
নতুন এই আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থায়—
- বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে
- স্থানীয় হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগ আসবে
- রোহিঙ্গা শিবির-সংলগ্ন এলাকায় মানবিক ও উন্নয়ন কার্যক্রমে লজিস্টিক সুবিধা বাড়বে
- স্থানীয় কৃষি, সামুদ্রিক খাদ্য ও হস্তশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি সহজ হবে
অবকাঠামো উন্নয়ন: আধুনিক কক্সবাজার বিমানবন্দর
গত কয়েক বছরে কক্সবাজার বিমানবন্দরে বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে ১০,৭০০ ফুট দৈর্ঘ্যের নতুন রানওয়ে সম্প্রসারণ, আধুনিক টার্মিনাল বিল্ডিং, কার্গো সুবিধা ও নাইট ল্যান্ডিং সিস্টেম (ILS) স্থাপন করা হয়েছে।
বিমানবন্দরের নির্মাণে ব্যবহৃত প্রযুক্তি ও নকশা আন্তর্জাতিক মানে তৈরি করা হয়েছে যাতে বোয়িং ৭৭৭ এবং ড্রিমলাইনার ৭৮৭ ধরনের বড় আকারের বিমান অবতরণ করতে পারে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB)-এর চেয়ারম্যান জানিয়েছেন,
“কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শুধু পর্যটন নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি আঞ্চলিক বিমান হাব হিসেবে গড়ে উঠবে।”
পর্যটন শিল্পে নতুন যুগের সূচনা
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (BPC) ও কক্সবাজার হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির মতে, এই ঘোষণা দেশের পর্যটন শিল্পে নতুন যুগের সূচনা করবে।
প্রতিবছর প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ দেশি পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণ করেন। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালুর ফলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা অন্তত ৫ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
- সরাসরি ফ্লাইট চালু হলে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, চীন, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটকরা সহজে কক্সবাজারে আসতে পারবেন।
- কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন-মহেশখালী পর্যটন বেল্টকে আন্তর্জাতিক মানে গড়ে তোলা যাবে।
- ইকো-ট্যুরিজম, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম ও সমুদ্রভিত্তিক নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়বে।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নতুন দিগন্ত
কক্সবাজার এখন শুধু পর্যটনের কেন্দ্র নয়, এটি হয়ে উঠছে একটি আঞ্চলিক বাণিজ্যকেন্দ্র। মহেশখালীতে সরকার ইতোমধ্যেই এলএনজি টার্মিনাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে।
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালুর ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সরাসরি কক্সবাজারে প্রবেশ করতে পারবেন। এতে—
- ব্যবসায়িক ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হবে
- মালামাল পরিবহনে সময় ও খরচ কমবে
- স্থানীয় পণ্য যেমন শুকনো মাছ, চিংড়ি, মুক্তা ও হস্তশিল্প বিদেশে সহজে পাঠানো সম্ভব হবে
স্থানীয় মানুষের জীবনে পরিবর্তন
কক্সবাজারের সাধারণ মানুষের কাছে এই ঘোষণা যেন আশীর্বাদ। স্থানীয় উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম বলেন—
“এখন বিদেশি পর্যটকরা সরাসরি কক্সবাজারে আসবে, এতে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্রাভেল এজেন্সি ও দোকানগুলোতে কাজের সুযোগ অনেক বেড়ে যাবে।”
শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবহন ব্যবস্থাও আরও উন্নত হবে বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা।
আঞ্চলিক সংযোগ ও দক্ষিণ এশিয়ার বিমানপথে নতুন রুট
কক্সবাজারের ভৌগোলিক অবস্থান এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে মাত্র এক ঘণ্টার উড়ান দূরত্বে রয়েছে কলকাতা, ইয়াঙ্গুন, ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুর।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বিমানবন্দর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মধ্যে আঞ্চলিক বিমান চলাচলের কেন্দ্র হতে পারে। এটি বিমসটেক (BIMSTEC) অঞ্চলের আঞ্চলিক সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করবে।
সরকারের পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন—
“আমরা চাই কক্সবাজার শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠুক। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালুর মাধ্যমে আমরা সেই লক্ষ্যে এগোচ্ছি।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে—
- আরও একটি আন্তর্জাতিক টার্মিনাল নির্মাণ
- কার্গো টার্মিনাল সম্প্রসারণ
- সরাসরি ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্য রুটে ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ
- বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকাকে ‘ট্যুরিজম সিটি’ হিসেবে গড়ে তোলা
কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উদ্বোধনের তারিখ ও প্রস্তুতি
প্রত্যাশা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্বোধন করবেন।
এর আগে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিমান, ইউএস-বাংলা ও নভোএয়ার কক্সবাজারে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আন্তর্জাতিক ঘোষণা কার্যকর হওয়ার পর বিমান সংস্থাগুলো নতুন রুট চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিশ্বমঞ্চে কক্সবাজারের নতুন পরিচয়
এই ঘোষণার ফলে কক্সবাজার শুধু একটি সমুদ্রসৈকত নয়, বরং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক গর্বের প্রতীক হয়ে উঠবে। এটি দেশের পর্যটন কূটনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নিরাপত্তা, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো ও আতিথেয়তা এখন বিশ্ববাসীর সামনে নতুনভাবে উপস্থাপিত হবে।
বাংলাদেশের আকাশপথে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অন্তর্ভুক্তি এক ঐতিহাসিক অর্জন। এটি শুধু একটি অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, বরং দেশের অর্থনীতি, পর্যটন ও বৈদেশিক বিনিয়োগে এক নতুন দিগন্তের সূচনা।
বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের নতুন পরিচয় গড়ে তুলবে কক্সবাজার—যেখানে আকাশ, সমুদ্র আর পাহাড় মিলেছে এক অনন্য সৌন্দর্যের ক্যানভাসে।
MAH – 13312 I Signalbd.com