বিশ্ব

কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক চিকিৎসক হুসাম আবু সাফিয়াকে মুক্তি দেবে না ইসরায়েল

Advertisement

গাজার শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হুসাম আবু সাফিয়া এখনও ইসরায়েলের কারাগারে আটক। গত বছরের ডিসেম্বরে গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় তাকে মারধর করে অপহরণ করা হয়। যদিও তিনি কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত নন, তবুও যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায়ও ইসরায়েল তাঁকে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

হামাসের এক কর্মকর্তা মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-কে জানিয়েছেন, চিকিৎসক সাফিয়ার মুক্তির কোনো পরিকল্পনা নেই। এ কর্মকর্তা বলেন, “দখলদার বাহিনী চিকিৎসক হুসাম আবু সাফিয়াকে মুক্তি দিতে রাজি নয়।”

ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী চিকিৎসক: ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

হুসাম আবু সাফিয়াকে অপহরণের সময় সাদা মেডিকেল অ্যাপ্রোন পরে ধ্বংসস্তূপে ভরা রাস্তা পার হতে দেখা যায়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তাঁকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে আটক রাখা হয়েছে এবং সম্ভবত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

তবে, হাসপাতালের প্র্যাকটিস এবং রোগীর জন্য কাজ করার কারণে সাফিয়ার বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তোলা হয়নি। এই কারণেই মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ অবস্থাকে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী হিসেবে দেখছে।

সাফিয়ার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি: মারধর ও অবহেলার প্রভাব

আইনজীবী ঘাইদ ঘানেম কাসেম জানিয়েছেন, সাফিয়ার শরীরের ওজন বর্তমানে প্রায় ৬০ কেজির নিচে, যা তার মোট ওজনের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হ্রাস। ২০২৩ সালের ২৪ জুন তাঁকে কারাগারে মারধর করা হয় এবং তাঁর চিকিৎসার জন্য করা সকল আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

কাসেম ফেসবুকে লিখেছেন, “আমি তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ ৯ জুলাই দেখা করি। তিনি ভয়ঙ্কর শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছেন, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন রয়েছে এবং সম্প্রতি তার চশমাটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে।”

এতে স্পষ্ট যে, সাফিয়ার মানবিক ও চিকিৎসা অধিকার পুরোপুরি লঙ্ঘিত হয়েছে।

হামাসের অন্যান্য চিকিৎসকও মুক্তি পাচ্ছেন না

সাফিয়ার পাশাপাশি, রাফার আবু ইউসুফ আল-নাজ্জার এবং মারওয়ান আল-হামসক নামের আরও দুই চিকিৎসককে মুক্তি দেওয়া হবে না। হামাস সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, তাঁরা গাজার ফিল্ড হাসপাতালের পরিচালক এবং তত্ত্বাবধায়ক।

২০২৫ সালের জুলাইয়ে, বেসামরিক পোশাকে থাকা ইসরায়েলি বাহিনী হামসকে অপহরণ করে। প্যালেস্টিনিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস (PCHR) জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী রেড ক্রসের ফিল্ড হাসপাতালের কাছে হামসকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এই অভিযানে ফটোসাংবাদিক তামের রেভি রফিক আল-জানিনইব্রাহিম আতেফ আতিয়াহ আবু আশেইবাহ নিহত হন।

পরে হামসকে একটি সাদা গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং বর্তমানে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

ইসরায়েলি কারাগারে আটক চিকিৎসক: মানবাধিকার পরিস্থিতি

গাজার প্রায় ২৮ জন চিকিৎসক বর্তমানে ইসরায়েলি কারাগারে আটক রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সার্জারি, অর্থোপেডিকস, ইনটেনসিভ কেয়ার, কার্ডিওলজি এবং পেডিয়াট্রিকসের সিনিয়র কনসালট্যান্ট রয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনি বন্দীরা ইসরায়েলি কারাগারে ব্যাপক ও গুরুতর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এই নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে:

  • অনাহারে রাখা
  • চিকিৎসায় অবহেলা
  • শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন
  • অপমান ও যৌন নিপীড়ন
  • নজিরবিহীনভাবে নির্জন কারাবাস

একজন বেসামরিক চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও হুসাম আবু সাফিয়াকে ইসরায়েলি আইনে ‘বেআইনি যোদ্ধা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর অর্থ, তাঁকে কোনো আদালতের আদেশ ছাড়াই আটক রাখা হয়েছে এবং কারাগারে তাঁর অবস্থান ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য গোপন রাখা হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটি আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

হুসাম আবু সাফিয়ার আটক ও কারাগারে মারধরের খবর আন্তর্জাতিক মহলে চাপ সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার সংস্থা এবং প্যালেস্টিনিয়ান স্বাস্থ্যকর্মী সমিতি এককভাবে দাবি করছে, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে এই ধরনের অপরাধ যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য

জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে, যে কোনো বন্দী ব্যক্তির চিকিৎসা, নিরাপত্তা এবং মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক আইনের একটি মৌলিক শর্ত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যুদ্ধক্ষেত্রে মানবিকতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য

সাফিয়ার মুক্তির আশা ও সামাজিক চাপ

ফিলিস্তিনি সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বর্তমানে চিকিৎসক সাফিয়ার মুক্তির জন্য চাপ তৈরি করছে। সামাজিক মাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিকরা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে বারবার স্মরণ করাচ্ছেন যে, চিকিৎসকরা কোনো রাজনৈতিক বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নয়, তারা শুধুমাত্র মানবিক সেবা প্রদানকারী

যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী অন্যান্য বন্দীর মুক্তি হলেও, সাফিয়ার মুক্তি না দেওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

চিকিৎসক হুসাম আবু সাফিয়ার আটক এবং কারাগারে অবহেলার ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবিক মূল্যবোধের আলোকে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে নিরাপত্তাহীন ও চিকিৎসা বঞ্চিত অবস্থায় রয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের বিনা অভিযোগে বন্দী রাখা এবং চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়া কেবল এক ব্যক্তির নয়, বরং ফিলিস্তিনি চিকিৎসক সমাজ এবং মানবিক কাজের ওপরও প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে এবং মানবাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে আশা করা হচ্ছে, চিকিৎসক সাফিয়ার মুক্তি এবং অন্যান্য চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু আইনগত নয়, মানবতার এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। হুসাম আবু সাফিয়ার মুক্তি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ন্যায় নয়, আন্তর্জাতিক মানবিকতা ও চিকিৎসা নীতি রক্ষারও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

MAH – 13307 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button