
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে। চলতি সপ্তাহে সীমান্তের একাধিক স্থানে দু’পক্ষের সেনা সংঘাতে অন্তত কয়েক ডজন নিহত হয়েছেন। দুই দেশের মধ্যে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের জেরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হচ্ছে।
সীমান্তে সংঘাতের প্রেক্ষাপট
গত বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) আফগান রাজধানী কাবুলে দুটি বিস্ফোরণ ঘটার পর, আফগানিস্তানের তালেবান সরকার পাকিস্তানকে দায়ী করে। একই সময়ে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী পাকতিয়া প্রদেশে আরও একটি বিস্ফোরণ ঘটে। আফগান প্রশাসন দাবি করেছে, পাকিস্তান তাদের ‘সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা’ চালিয়েছে। পাকিস্তান স্পষ্টভাবে অভিযোগ অস্বীকার না করলেও জানিয়েছে, তারা তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে কারণ টিটিপি আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় ঘাঁটি গড়ে রেখেছে এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। পাকিস্তান দাবি করেছে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে টিটিপির হামলায় অন্তত ২ হাজার ৪১৪ জন নিহত হয়েছে।
সংঘর্ষের বিস্তারিত
শনিবার রাতে সীমান্তের একাধিক স্থানে পাকিস্তান ও আফগান বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘাত ঘটে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তাদের ২৩ জন সৈন্য নিহত এবং ২৯ জন আহত হয়েছে। পাশাপাশি তারা দাবি করেছে, এ সময় অন্তত দুই শতাধিক তালেবান যোদ্ধা নিহত হয়েছে এবং তাদের ক্যাম্প ধ্বংস করা হয়েছে।
অপরদিকে আফগানিস্তান তালেবান প্রশাসন দাবি করেছে, প্রতিশোধমূলক অভিযানে অন্তত ৫৮ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে। দুই দেশের সেনারা একে অপরের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং সীমান্ত এলাকায় সেনা জড়ো করা হচ্ছে।
ডুরান্ড লাইন ও সীমান্ত বিরোধ
সংঘাতের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডুরান্ড লাইন। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ শাসনের সময় নির্ধারিত এই সীমান্ত পাকিস্তান স্বীকার করলেও আফগানিস্তান কখনোই তা মেনে নেয়নি। আফগানিস্তান বরাবরই এই সীমান্তকে ‘কাল্পনিক রেখা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
ডুরান্ড লাইন নিয়ে দীর্ঘদিনের বিবাদ এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় টিটিপির কার্যক্রম বর্তমান সংঘাতের মূল উৎস হিসেবে ধরা হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ইতিহাস এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস এই সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে।
প্রভাব ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করছে। ইরান, কাতার ও সৌদি আরবসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয় পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উভয় দেশের প্রতি শান্ত থাকার অনুরোধ করেছেন। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে উত্তেজনা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না এলে সংঘাত পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা চিত্রে নতুন অস্থিতিশীল অধ্যায় যোগ করতে পারে।
পাকিস্তান-আফগান সম্পর্কের ইতিহাস
১৯৯৬ সালে তালেবান প্রথমবার আফগানিস্তানে সরকার গঠন করলে পাকিস্তান তাদের স্বীকৃতি প্রদান করে। তবে ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশের পর পাকিস্তানের তালেবান সহায়তার অভিযোগ ওঠে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে ইসলামাবাদ-কাশ্মীর সীমান্তে সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগে দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে।
ইসলামাবাদ অভিযোগ করছে, আফগানিস্তান তাদের ভূখণ্ডে পাকিস্তানের নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী টিটিপিকে আশ্রয় দিচ্ছে। আফগানিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করছে।
বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক মতামত
পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আফগান বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি আসিফ দুররানি মনে করেন, “এই সংঘাত গুরুতর আকার নেবে না। পাকিস্তানের সামরিক ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সমাধান ছাড়া উত্তেজনা থাকবে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, টিটিপি আশ্রয়, সীমান্ত বিরোধ এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস হলো এই সংঘাতের মূল কেন্দ্র। যেকোনো শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কূটনৈতিক সংলাপ অপরিহার্য।
পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে সাম্প্রতিক সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য সতর্কবার্তা। ডুরান্ড লাইন ও টিটিপি কার্যক্রমের কারণে দুই দেশের সম্পর্ক এখন সংকটময়। কূটনৈতিক সংলাপ ও আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া উত্তেজনা কমানো কঠিন হবে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কতটা গড়াবে, তা মূলত দুই দেশের সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে।
এম আর এম – ১৭৪৬,Signalbd.com