
পটুয়াখালীর বাউফলে নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ মাছ কিনতে গিয়ে নৌ-পুলিশের অভিযানে আতঙ্কিত হয়ে তেঁতুলিয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন রাসেল খান (৩৫) নামের এক ব্যক্তি। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও এখনো তার কোনো খোঁজ মেলেনি। এ ঘটনায় এলাকাজুড়ে চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
নিখোঁজ রাসেল খান উপজেলার নাজিরপুর-তাঁতেরকাঠি ইউনিয়নের ইউসুফ খানের ছেলে। শনিবার (১১ অক্টোবর) সন্ধ্যার দিকে এই ঘটনাটি ঘটে। রোববার সকাল থেকে ডুবুরি দল নদীতে তল্লাশি চালাচ্ছে, তবে এখন পর্যন্ত তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
ঘটনার বিস্তারিত
নৌ-পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সন্ধ্যার দিকে রাসেল খানসহ চারজন একটি ছোট নৌকায় করে নদীতে ইলিশ মাছ কিনতে যান। পরে তারা মাছ নিয়ে ফেরার সময় তেঁতুলিয়া নদী হয়ে কালাইয়া ইউনিয়নের আলোকি খালের মুখে পৌঁছালে নৌ-পুলিশের একটি টহল দল তাদের লক্ষ্য করে। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আতঙ্কিত রাসেল নদীতে ঝাঁপ দেন।
সঙ্গে থাকা অন্য দুই ব্যক্তি দ্রুত পাশের একটি ট্রলারে উঠে পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলে থাকা আরও একজনকে মাছসহ দেখা গেলেও মানবিক কারণে পুলিশ তাকে আটক করেনি বলে জানিয়েছে স্থানীয় নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি।
উদ্ধার অভিযান চলছে
ঘটনার পর থেকে কালাইয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল যৌথভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। রোববার সকাল থেকে শুরু হওয়া এ অনুসন্ধান অভিযান সোমবার সকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। নদীর গভীর স্রোত, কাদাযুক্ত তলদেশ ও প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধারকাজে জটিলতা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
কালাইয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) আল মামুন বলেন, “নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ ধরার বিরুদ্ধে অভিযান চলছিল। তখনই খবর পাই এক ব্যক্তি নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ডুবুরি দল দিয়ে অনুসন্ধান শুরু করি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।”
তিনি আরও জানান, “প্রবাহমান নদীতে জোয়ার-ভাটার কারণে অনুসন্ধান কিছুটা কঠিন হয়ে পড়েছে, তবে নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
পরিবার ও স্থানীয়দের উদ্বেগ
নিখোঁজ রাসেলের খোঁজ না মেলায় তার পরিবার গভীর উদ্বেগে রয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতিদিনের মতোই তিনি মাছ কেনার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন। তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না, এমন এক ঘটনায় তার প্রাণহানির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
রাসেলের ভাই কামরুল খান বলেন, “আমার ভাই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে শুনে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাই। কিন্তু এতক্ষণেও তার কোনো খোঁজ নেই। আমরা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি যেন দ্রুত তাকে উদ্ধার করা হয়।”
ঘটনার পর নদীর পাড়ে শত শত স্থানীয় মানুষ ভিড় করেন। কেউ কেউ ডুবুরি দলের সঙ্গে সহযোগিতা করেন, আবার কেউ নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজে নৌকা নিয়ে নদীতে নামেন।
নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ ধরা ও সরকারের কঠোর অভিযান
উল্লেখ্য, মা ইলিশ রক্ষায় প্রতি বছর প্রজনন মৌসুমে ২২ দিনের জন্য ইলিশ ধরা, বিক্রি, পরিবহন ও মজুত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। এ বছরও ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে।
এই সময়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ বড় নদ-নদীতে যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করছে মৎস্য অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ ও প্রশাসন। নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা ও কারাদণ্ডের ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
তবে কিছু অসাধু জেলে ও ব্যবসায়ী লোভের বশে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে নামছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এর ফলে পুলিশি অভিযানের ঘটনাও প্রায়ই ঘটছে।
বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় প্রশাসনের মন্তব্য
মৎস্য অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্মকর্তা আবদুল হান্নান বলেন, “নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ ধরা পুরোপুরি আইনবিরুদ্ধ। নদী ও প্রজনন ক্ষেত্র রক্ষায় আমরা প্রতিদিন টহল দিচ্ছি। এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে।”
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও মনে করছেন, জেলেদের জীবিকা সংকটের কারণেই তারা মাঝে মাঝে ঝুঁকি নিচ্ছেন। উপজেলা পরিষদের এক সদস্য বলেন, “আমরা বারবার অনুরোধ করছি যেন কেউ নিষিদ্ধ সময়ে নদীতে না নামে। সরকার বিকল্প কর্মসংস্থানও দিচ্ছে, কিন্তু সবাই সেটা গ্রহণ করছে না।”
পদক্ষেপ ও তদন্ত
নৌ-পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাটির তদন্ত চলছে। তারা নৌকার মালিকসহ সহযোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, কীভাবে ঘটনাটি ঘটল এবং পুলিশের উপস্থিতিতে কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উদ্ধার অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীতে বাড়তি টহল জারি থাকবে। একইসঙ্গে নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ ক্রয়-বিক্রয় বা পরিবহনের বিরুদ্ধে অভিযান আরও জোরদার করা হবে।
ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু এ ধরনের নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা বা কেনাবেচা শুধু আইন লঙ্ঘন নয়, এটি ভবিষ্যতে মাছের উৎপাদনকেও হুমকিতে ফেলছে। তেঁতুলিয়া নদীতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি তাই শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়—এটি আমাদের সচেতনতার ঘাটতিরও একটি প্রতিফলন।
প্রশাসন বলছে, নিখোঁজ রাসেল খানের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে। তবে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—জীবিকার তাগিদে কি মানুষকে এমন ঝুঁকি নিতেই হবে, নাকি আমরা সবাই মিলে এর বিকল্প পথ খুঁজে নিতে পারি?
এম আর এম – ১৭৩৫,Signalbd.com