
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে ৯৫৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩০ জনে, আর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পেরিয়ে গেছে ৫৪ হাজার ৫৫৯ জনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংক্রমণ এখনো ঊর্ধ্বমুখী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য
রবিবার (১২ অক্টোবর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৯৫৩ জন রোগী।
এর মধ্যে ঢাকার বাইরে সর্বাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন বরিশাল বিভাগে ১৪১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১০৭ জন এবং খুলনা বিভাগে ৯৩ জন। ঢাকা বিভাগে (সিটি এলাকার বাইরে) ভর্তি হয়েছেন ১৯৭ জন। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৪৭ জন ও দক্ষিণ সিটিতে ১২২ জন নতুন করে ভর্তি হয়েছেন। ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ৬৯ জন, রংপুর বিভাগে ২৩ জন এবং সিলেট বিভাগে ৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮৫৪ জন রোগী। ফলে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ছাড়পত্র পাওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৭৮৩ জনে।
মৃতের সংখ্যা ও আক্রান্তের চিত্র
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৩০। গত বছরের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ৫৭৫। যদিও ২০২৩ সালে দেশে রেকর্ডসংখ্যক ১,৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি বছরের মৃত্যু সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও আক্রান্তের হার এখনো উদ্বেগজনক।
ঢাকায় পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক
রাজধানী ঢাকা এখনো ডেঙ্গু সংক্রমণের মূল কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন রোগীর অর্ধেকেরও বেশি শনাক্ত হচ্ছে ঢাকায়। আবাসিক ভবনের ছাদ, ফুলের টব, নির্মাণাধীন ভবন ও জলাবদ্ধ স্থানে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার বংশবিস্তার বাড়ছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দাবি করছে, নিয়মিত মশা নিধন কার্যক্রম চললেও সচেতনতার অভাবের কারণে এডিস মশার বিস্তার পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও বিশ্লেষণ
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ডা. সেলিম মাহমুদ, সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, বলেন, “ডেঙ্গু প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা। ঘরের আশেপাশে পানিজমা না রাখলে সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলোকে পর্যাপ্ত বেড, স্যালাইন ও প্লেটলেট সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও অফিসে মশারোধী স্প্রে ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
পূর্ববর্তী বছরের তুলনামূলক চিত্র
২০২৩ সালে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি মানুষ, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২৪ সালে আক্রান্ত হন ১ লাখ ১ হাজারের বেশি মানুষ এবং মারা যান ৫৭৫ জন।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ৫৫৯ জন। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, অক্টোবরের শেষ দিকে মশার বংশবৃদ্ধি আরও বাড়লে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে পারে।
প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ ও জনসচেতনতা
ঢাকা সিটি করপোরেশনগুলো জানিয়েছে, তারা এডিস মশা নিধনে মাইকিং, ফগিং, ওয়ার্ডভিত্তিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং বিশেষ টিমের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে।
তবে নাগরিকদের অংশগ্রহণ ছাড়া এই উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবা রহমান বলেন, “মশা নিধনে কেবল সরকারের উদ্যোগ নয়, প্রতিটি নাগরিককে নিজের বাড়ি ও আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে হবে। অন্যথায় ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।”
ডেঙ্গুর সংক্রমণ রোধে সরকারি প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও বাস্তব চিত্র এখনো উদ্বেগজনক। প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কমছে না, বরং ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এখনই যদি সচেতনতা না বাড়ে, তবে বছরের শেষ দিকে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। সময়মতো পদক্ষেপই এই মহামারি রোধের একমাত্র উপায়।
এম আর এম – ১৭৩৩,Signalbd.com