
নরওয়ের রাজধানী অসলোতে আগামী শুক্রবার ঘোষণা করা হবে এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের বিজয়ীর নাম। বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টায় নোবেল কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে কে পাচ্ছেন শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই সম্মাননা।
প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্বজুড়ে রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ, গুঞ্জন ও জল্পনা-কল্পনা। কে হচ্ছেন ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জয়ী? কোন ব্যক্তি বা সংস্থা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রেখে সবার থেকে আলাদা হয়ে উঠবেন—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, গবেষক, শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের গুরুত্ব
নোবেল শান্তি পুরস্কার শুধু একটি সম্মান নয়, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত পুরস্কারগুলোর একটি। ১৮৯৫ সালে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুযায়ী এই পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়। প্রতি বছর শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রাখা ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হয় এই পুরস্কার।
অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস, যুদ্ধবিরতি, কূটনৈতিক সমঝোতা, মানবাধিকার রক্ষা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নারী ও শিশুর অধিকার নিশ্চিতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও শরণার্থীদের সহায়তার মতো কাজগুলো এই পুরস্কারের যোগ্য বিবেচিত হয়।
নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০২৫: কারা আছেন আলোচনায়?
এবারের শান্তি নোবেলের জন্য ৩৩৮ জন ব্যক্তি ও সংস্থা মনোনীত হয়েছেন। যদিও নোবেল কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নাম প্রকাশ করে না, তবে বিভিন্ন সূত্র ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম তুলে ধরে থাকে।
আলোচনায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বিশ্বব্যাপী শান্তি ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তাঁর নেতৃত্ব আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এবার শান্তি নোবেল তাঁর হাতে উঠতে পারে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এগিয়ে
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে কাজ করা সংগঠনগুলোকেও শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে দেখা হচ্ছে। গাজ্জা ও সিরিয়ার মানবিক সংকট মোকাবিলায় যারা কাজ করছে, তারা আলোচনায় রয়েছে।
বিতর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, আটটি বড় সংঘাত সমাধানে তিনি অবদান রেখেছেন এবং ভারত-পাকিস্তানকে পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম্পের দাবিগুলো অতিরঞ্জিত এবং অনেক নীতিই নোবেলের শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণের আদর্শের বিপরীতে যায়।
সুইডিশ অধ্যাপক পিটার ওয়ালেনস্টিন বলেন, “গাজ্জা সংকটসহ ট্রাম্পের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এখনো মানুষের মনে তাজা। তাই এ বছর তাঁকে পুরস্কার দেওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম।”
অসলোর পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান নিনা গ্রেগারও একই মত দিয়েছেন। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়া, বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মতো কর্মকাণ্ড ট্রাম্পের শান্তি দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের ইতিহাসে কিছু উল্লেখযোগ্য বিজয়ী
- ১৯৬৪ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের জন্য পুরস্কার পান।
- ১৯৯১ সালে অং সান সু চি বার্মায় (বর্তমানে মিয়ানমার) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য পুরস্কৃত হন।
- ২০০৯ সালে বারাক ওবামা বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য পুরস্কার পান।
- ২০১৪ সালে মালালা ইউসুফজাই পাকিস্তানে মেয়েদের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকার জন্য সর্বকনিষ্ঠ শান্তি নোবেলজয়ী হন।
- ২০২১ সালে মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য পুরস্কৃত হন।
নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০২৫: কেন এত আগ্রহ?
বিশ্বজুড়ে চলমান যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, জলবায়ু সংকট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সময় যখন মানুষের মনে হতাশা ভর করছে, তখন শান্তি নোবেল আশার আলো দেখায়। এটি শুধু পুরস্কার নয়, এটি একটি দিকনির্দেশনা, যে কাজগুলো মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করা ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর জন্য এই পুরস্কার বিশ্ব স্বীকৃতি এনে দেয়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ ও নোবেল শান্তি পুরস্কার
বাংলাদেশও একবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে। ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস যৌথভাবে এই পুরস্কার লাভ করেন। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বিশ্বে প্রশংসিত হয়।
বাংলাদেশের মানুষ তাই শান্তি নোবেল নিয়ে সবসময়ই বাড়তি আগ্রহ নিয়ে খোঁজখবর রাখে।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে এ বছরের সম্ভাবনা
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বছর পুরস্কারের জন্য এগিয়ে রয়েছেন মানবিক সহায়তামূলক সংগঠনগুলো এবং জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম যতই আলোচনায় আসুক, বাস্তবে তাঁর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
তবে নোবেল শান্তি পুরস্কারের ইতিহাস বলছে, অনেক সময় প্রত্যাশিত ব্যক্তি বা সংস্থা নয়, বরং হঠাৎ করেই কোনো অজানা বা আলোচনার বাইরে থাকা সংস্থা বিজয়ী হয়ে যায়। তাই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, কার হাতে উঠবে এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার।
নোবেল শান্তি পুরস্কার কেবল একটি পদক বা অর্থমূল্য নয়, এটি মানবতার জন্য অনুপ্রেরণা। যুদ্ধবিধ্বস্ত, বিভক্ত এবং অস্থির পৃথিবীতে যারা শান্তির স্বপ্ন দেখে, তাদের জন্য এই পুরস্কার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
শুক্রবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টায় বিশ্ববাসী জানতে পারবে, ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার কার হাতে উঠছে। তবে যেই জয়ী হোন না কেন, তাঁর কাজ বিশ্বকে মনে করিয়ে দেবে—শান্তিই মানবজাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ।
MAH – 13242 I Signalbd.com