
ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে ৭০০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টার ডেঙ্গু চিত্র
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানায়, নতুন আক্রান্ত ৭০০ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকায় শনাক্ত হয়েছে। ঢাকা মহানগরের উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৫৫ জন এবং দক্ষিণ সিটিতে ১১০ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় ভর্তি হয়েছেন আরও ১৪৯ জন।
বিভাগভিত্তিক হিসেবে দেখা যায়, বরিশাল বিভাগে ১০৫ জন, চট্টগ্রামে ৬১ জন, খুলনায় ৪৫ জন, ময়মনসিংহে ৩৩ জন, রাজশাহীতে ৩১ জন, রংপুরে ৬ জন এবং সিলেট বিভাগে ৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
চলতি বছরে মোট আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৫২ হাজার ১০৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন বেশিরভাগ রোগী, তবে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২০ জনে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদিও সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমেছিল, তবে অক্টোবরের শুরুতেই সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অক্টোবরে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
ঢাকায় সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি
ডেঙ্গুর প্রকোপ এখনো সবচেয়ে বেশি ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে আক্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য বিভাগের তুলনায় অনেক বেশি। ঘনবসতি, জলাবদ্ধতা, এবং অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে বিশেষজ্ঞরা এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন।
ঢাকার পাশাপাশি বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগেও আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এসব অঞ্চলে মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতা বাড়ানো হলেও এখনো পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সতর্কতা ও নির্দেশনা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এডিস মশার প্রজনন দ্রুত বাড়ছে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি, ফুলের টব, পুরনো টায়ার, কিংবা ছাদের ড্রেনে যেন পানি না জমে, সে বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি করতে বলা হয়েছে।
অধিদপ্তর বলেছে, সামান্য জ্বর এলেও অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বিশেষ করে বাচ্চা, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর জটিলতা বেশি দেখা যায়।
মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় উদ্যোগ
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, নিয়মিত ফগিং ও লার্ভিসাইড ছিটানো হচ্ছে। পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতন করতে মাইকিং, পোস্টার ও গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে।
তবে নাগরিকরা অভিযোগ করছেন, অনেক এলাকায় এখনো মশা মারার কার্যক্রম নিয়মিত নয়। বিশেষ করে অলিগলি ও আবাসিক এলাকায় মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়; সাধারণ মানুষকেও সক্রিয় হতে হবে। প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসা ও কর্মস্থল পরিষ্কার রাখতে হবে, যেন এডিস মশার প্রজননের সুযোগ না থাকে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সময়মতো রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা নেওয়ার মাধ্যমে মৃত্যুহার অনেক কমানো সম্ভব। পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীদের জন্য হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড, ওষুধ ও প্লেটলেট সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতির আহ্বান
বিশ্লেষকদের মতে, এখন থেকেই যদি কঠোরভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করা হয়, তাহলে নভেম্বরের মধ্যে সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।
স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, “ডেঙ্গু এখন মৌসুমি রোগ নয়, এটি এখন সারাবছরের ঝুঁকি। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।”
ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নাগরিকদের সচেতনতা এবং প্রশাসনিক তৎপরতা—দুই দিকেই জোর দিতে হবে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এম আর এম – ১৬৭৯,Signalbd.com