বিশ্ব

১৯ ভারতীয় প্রক্সি সন্ত্রাসী নিহত, ১১ পাকিস্তানি সেনা শহীদ

Advertisement

পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবার পাখতুনখোয়ার ওরাকজাই জেলায় চালানো সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে ১৯ জন ভারতীয় প্রক্সি সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। এ অভিযানে পাকিস্তান সেনার এক লেফট্যানেন্ট কর্নেল, এক মেজরসহ ১১ জন সেনা প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিডিয়া শাখা ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতীয় মদদপুষ্ট জঙ্গি সংগঠন ফিতনা আল-খোয়ারিজ–এর সদস্যরা ওরাকজাই অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) রাতে গোপন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে গোলাগুলির তীব্র সংঘর্ষ হয়, যেখানে ১৯ জন সন্ত্রাসী নিহত হয় এবং তাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করা হয়।

তবে এ অভিযানে পাকিস্তান সেনারও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। লেফট্যান্যান্ট কর্নেল জুনায়েদ তারিক (৩৯) এবং মেজর তৈয়ব রাহাত (৩৩)সহ মোট ১১ সেনা শহীদ হন। আইএসপিআর জানিয়েছে, তাদের এ আত্মত্যাগ দেশের জন্য গৌরবের এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন প্রেরণা জোগাবে।

শাহবাজ শরীফের প্রতিক্রিয়া

অভিযানের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ শহীদ সেনাদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তার কার্যালয় থেকে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়, “দেশের জন্য জীবন দেওয়া প্রতিটি শহীদের রক্ত আমাদের জাতির অটল সংগ্রামের প্রতীক। পাকিস্তান কখনো সন্ত্রাসবাদীদের কাছে মাথানত করবে না।”

তিনি আরও বলেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা আরআইএস (RAW) দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের ভেতরে প্রক্সি সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক তৈরি করে অস্থিতিশীলতা ছড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তা মোকাবিলায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

ভারতীয় প্রক্সি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে বিতর্ক

দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ। কাশ্মীর ইস্যু, সীমান্ত বিরোধ, এবং সন্ত্রাসবাদের পেছনে কে আসল মদদদাতা—এসব প্রশ্নে দুই দেশ প্রায়শই একে অপরকে অভিযুক্ত করে।

পাকিস্তানের দাবি, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (RAW) আফগানিস্তান ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ দিয়ে পাকিস্তানের ভেতরে হামলার পেছনে কাজ করছে।

অন্যদিকে ভারত অভিযোগ করে, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলো কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালায়। দুই দেশের এই পরস্পরবিরোধী অভিযোগ দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে বারবার হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

ফিতনা আল-খোয়ারিজ: কারা এরা?

আইএসপিআরের দাবি অনুযায়ী নিহত সন্ত্রাসীরা “ফিতনা আল-খোয়ারিজ” নামের এক সংগঠনের সদস্য। এ গোষ্ঠী মূলত পাকিস্তানের ভেতরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উসকে দেওয়া, সেনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা, এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় অস্থিতিশীলতা তৈরির কাজে লিপ্ত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংগঠনের সঙ্গে আফগানিস্তানভিত্তিক কিছু জঙ্গি গোষ্ঠীরও যোগাযোগ রয়েছে। ধারণা করা হয়, তাদেরকে ভারতের পক্ষ থেকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে।

ওরাকজাই জেলা: কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা

ওরাকজাই পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের একটি পার্বত্য জেলা। আফগান সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় এ অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর জন্য আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী গত দুই দশকে একাধিকবার এখানে অভিযান চালিয়েছে।

২০০৭ সালের পর থেকে এ অঞ্চলে তালেবানসহ বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে। স্থানীয় উপজাতিদের ওপর দমননীতি, বিদেশি অর্থায়ন, এবং সীমান্তপথের সুবিধা কাজে লাগিয়ে তারা এখানে নেটওয়ার্ক তৈরি করে। ফলে এ এলাকা পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আন্তর্জাতিক মহলেও সাড়া পড়ে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ সাফল্য শুধু সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক দুর্বল করতেই নয়, বরং ভারতের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক বার্তা দিতেও কার্যকর হবে।

চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, “পাকিস্তান সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ যুদ্ধে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে হবে।”

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় পাকিস্তানের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানালেও, দুই দেশের মধ্যে আফগানিস্তান ইস্যুতে নানামুখী টানাপোড়েন থাকায় সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

শহীদ সেনাদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধা

পাকিস্তানে শহীদ সেনাদের জানাজা জাতীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু মানুষ সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এবং তাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করছেন।

একজন শহীদের পরিবার গণমাধ্যমে বলেন, “আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আমরা শোকাহত হলেও গর্বিত। তার রক্ত বৃথা যাবে না।”

দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন উত্তেজনার আশঙ্কা

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তানের এ অভিযান ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তুলতে পারে। সম্প্রতি কাশ্মীর সীমান্তে গোলাগুলি, আফগানিস্তানকে ঘিরে উভয় দেশের কূটনৈতিক টানাপোড়েন, এবং প্রক্সি সন্ত্রাসবাদ—এসব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

ওরাকজাই জেলার এই অভিযান পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। ১৯ জন ভারতীয় প্রক্সি সন্ত্রাসীর মৃত্যু নিঃসন্দেহে পাকিস্তান সেনার জন্য একটি বড় অর্জন। তবে ১১ সেনার প্রাণহানি দেশের জন্য গভীর শোক ও ক্ষতির কারণ হয়ে থাকবে।

এ ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো, দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে হলে সন্ত্রাসবাদ ও প্রক্সি যুদ্ধের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। না হলে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের শিকার হতেই থাকবে।

MAH – 13236 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button