স্বাস্থ্য

বেবি পাউডারে ক্যানসারের উপাদান: জনসন অ্যান্ড জনসনকে কোটি ডলার জরিমানা

Advertisement

বিশ্বের অন্যতম বড় ফার্মাসিউটিক্যাল ও ভোক্তাপণ্য নির্মাতা কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসন আবারও চরম আইনি জটিলতায় পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদালত সম্প্রতি কোম্পানিটিকে প্রায় ৯৬০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা) জরিমানা দেওয়ার আদেশ দিয়েছে। অভিযোগ— তাদের তৈরি বেবি পাউডারে ক্ষতিকর অ্যাসবেস্টস নামক উপাদান পাওয়া গেছে, যা এক নারীর মেসোথেলিওমা ক্যানসারের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে চলা জনসন বেবি পাউডার বিতর্ক আবারও নতুন করে সামনে এলো। শিশুর জন্য নিরাপদ বলে প্রচারিত এই পণ্য আসলেই কতটা নিরাপদ— এ প্রশ্ন আজ আবারও আলোচনায়।

বিরল ক্যানসারে এক নারীর মৃত্যু ও পরিবারের মামলা

রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা মে মুর নামের এক নারী ২০২১ সালে ৮৮ বছর বয়সে মেসোথেলিওমা ক্যানসারে মারা যান। মৃত্যুর পরপরই তাঁর পরিবার জনসন অ্যান্ড জনসনের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলায় অভিযোগ করা হয়, কোম্পানির তৈরি ট্যালকম পাউডারে অ্যাসবেস্টস ছিল।

অ্যাসবেস্টস হলো সূক্ষ্ম তন্তু জাতীয় খনিজ পদার্থ, যা শ্বাসযন্ত্র বা দেহের ভেতরে প্রবেশ করলে ক্যানসারসহ ভয়াবহ রোগ সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাবে ফুসফুস ক্যানসার, ডিম্বাশয় ক্যানসার এবং মেসোথেলিওমা হতে পারে বলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত।

আদালতের রায় ও ক্ষতিপূরণের অঙ্ক

লস অ্যাঞ্জেলেসের আদালতের জুরি রায়ে জানায়— জনসন অ্যান্ড জনসন মে মুরের মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী। আদালত কোম্পানিটিকে ১৬ মিলিয়ন ডলার (ক্ষতিপূরণ) এবং ৯৫০ মিলিয়ন ডলার (শাস্তিমূলক ক্ষতিপূরণ) প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে সাধারণত শাস্তিমূলক ক্ষতিপূরণের অঙ্ক ক্ষতিপূরণের নয় গুণের বেশি হতে পারে না। ফলে আইনি আপিলের মাধ্যমে এই অর্থ কিছুটা কমানো হতে পারে।

জনসনের প্রতিক্রিয়া: “এটি ভুয়া বিজ্ঞান”

রায়ের বিরুদ্ধে কোম্পানির আইনজীবীরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। জনসনের আইনি বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট এরিক হাস বলেছেন,
“এটি ভয়াবহ ও অসাংবিধানিক রায়। বাদীপক্ষ মিথ্যা ও ভুয়া বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে মামলা করেছে। আমাদের পণ্যে কখনোই অ্যাসবেস্টস ছিল না।”

কোম্পানিটি দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে— তাদের বেবি পাউডার শতভাগ নিরাপদ, এটি ক্যানসার সৃষ্টি করে না। তবে আদালতের রায় এবং অতীতের একাধিক মামলা সেই দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

জনসন অ্যান্ড জনসনের বিরুদ্ধে আগের অভিযোগ

এটাই প্রথম নয়। জনসন অ্যান্ড জনসনের বিরুদ্ধে গত এক দশকে হাজার হাজার ভোক্তা মামলা করেছেন।

  • ২০১৮ সালে মিসৌরি রাজ্যের আদালত কোম্পানিকে প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে রায় দিয়েছিল। অভিযোগ ছিল— তাদের ট্যালকম পাউডার ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেকেই ডিম্বাশয় ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন।
  • ২০২০ সালে কোম্পানি ঘোষণা করে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বেবি পাউডার বিক্রি বন্ধ করা হবে
  • ২০২৩ সালে জনসন অ্যান্ড জনসন জানায়, তারা বিশ্বজুড়ে ট্যালকম পাউডারের পরিবর্তে কর্নস্টার্চ বেসড পাউডার বাজারে আনবে।

এই সিদ্ধান্তগুলো প্রমাণ করে যে, ভোক্তাদের চাপ এবং আদালতের মামলার কারণে কোম্পানিটি ধীরে ধীরে তাদের পুরনো পণ্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হচ্ছে।

ট্যালকম পাউডারে অ্যাসবেস্টস কেন থাকে?

ট্যালক একটি প্রাকৃতিক খনিজ পদার্থ, যা পাউডার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ট্যালকের খনি বা মাটি থেকে উত্তোলনের সময় প্রায়ই অ্যাসবেস্টসের সংমিশ্রণ থেকে যায়। সঠিকভাবে পরিশোধন না করলে সেটি পণ্যে থেকে যেতে পারে।

চিকিৎসা গবেষণা বলছে, অ্যাসবেস্টসের ক্ষুদ্র কণিকা শরীরে প্রবেশ করলে কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের জন্ম দেয়। এ কারণেই বহু দেশ অ্যাসবেস্টসের ব্যবহার সীমিত বা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে।

মেসোথেলিওমা ক্যানসার: কতটা ভয়াবহ?

মেসোথেলিওমা হলো বিরল এক ধরনের ক্যানসার, যা ফুসফুস বা উদরগহ্বরের আস্তরণে হয়। সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে অ্যাসবেস্টসের সংস্পর্শে থাকলে এই ক্যানসার হয়।

এর উপসর্গগুলো হলো—

  • শ্বাসকষ্ট
  • বুকে ব্যথা
  • ক্রমাগত কাশি
  • ক্লান্তি
  • অস্বাভাবিক ওজন কমে যাওয়া

চিকিৎসকরা জানান, একবার এই ক্যানসার হলে আরোগ্য প্রায় অসম্ভব, তবে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর আয়ু কিছুটা বাড়ানো যায়।

জনসনের পণ্য এখনও বাজারে

বিতর্ক ও মামলা সত্ত্বেও বিশ্বের বহু দেশে এখনও জনসন অ্যান্ড জনসনের পণ্য বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে এখনও তাদের বেবি পাউডার পাওয়া যায়।

তবে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের মধ্যে এখন প্রশ্ন উঠছে— এমন পণ্য ব্যবহার করা উচিত কি না? শিশুদের জন্য নিরাপদ বলে প্রচারিত হলেও, বিভিন্ন গবেষণা ও আদালতের রায় প্রমাণ করছে এর ভেতরে ঝুঁকি রয়েছে।

ভোক্তাদের সতর্কবার্তা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের ত্বকে রাসায়নিক বা খনিজ পাউডার ব্যবহার এড়িয়ে চলা উচিত। প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা নিরাপদ।

বাংলাদেশের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও এর আগেও বিভিন্ন সময়ে প্রসাধনী পণ্যের মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে— জনসন অ্যান্ড জনসনের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পণ্য কতটা নিরাপদভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ প্রভাব

এই মামলার রায় শুধু জনসন অ্যান্ড জনসনের জন্য নয়, বিশ্বজুড়ে প্রসাধনী ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের জন্য বড় সতর্কবার্তা। ভোক্তারা এখন আরও সচেতন এবং কোম্পানিগুলোকে তাদের পণ্যের নিরাপত্তা প্রমাণে জোর দিতে হবে

আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি এই রায় বহাল থাকে তবে জনসন অ্যান্ড জনসনকে ভবিষ্যতে আরও বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে। ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে ৪০ হাজারেরও বেশি মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

জনসন অ্যান্ড জনসনের বেবি পাউডার একসময় সারা বিশ্বে বিশ্বাস ও ভালোবাসার প্রতীক ছিল। কিন্তু একের পর এক মামলা, আদালতের রায়, এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রমাণ করছে— এই আস্থার ভেতরে লুকিয়ে ছিল ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি।

আজকের আদালতের রায় শুধু এক নারীর পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নয়, বরং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ভোক্তার জন্য সতর্কবার্তা। শিশুদের নামে বিক্রি হওয়া কোনো পণ্য যদি নিরাপদ না হয়, তবে তার দায় কোম্পানিকে নিতেই হবে।

MAH – 13235 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button