বিশ্ব

বাগরামে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ‘অগ্রহণযোগ্য’, পাকিস্তান–চীনের সঙ্গে এক সুর ভারতের

Advertisement

ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র–ভারত সম্পর্কের কাঠামোতে নতুন দিকনির্দেশনা এসেছে। এই পরিবর্তন ভারতের চীন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সমন্বিত অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে। নয়াদিল্লি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি অগ্রহণযোগ্য এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এটি হুমকি স্বরূপ।

এই অবস্থান প্রকাশিত হলো এমন এক সময়ে, যখন আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি তাঁর ভারত সফরের দিন নির্ধারণ করেছেন। এ সফর হবে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর।

মস্কো ফরম্যাট সভা ও যৌথ বিবৃতি

গত মঙ্গলবার মস্কোতে অনুষ্ঠিত ‘মস্কো ফরম্যাট কনসালটেশনস অন আফগানিস্তান’ শীর্ষক সপ্তম সভায় আফগানিস্তান, ভারত, চীন, পাকিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান এবং ইরানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিশেষ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও অতিথি হিসেবে বেলারুশের একটি প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিল।

সভার যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অন্য কোনো দেশের সামরিক অবকাঠামো স্থাপনের চেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়। বিবৃতিতে সরাসরি বাগরামের নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবে স্পষ্টভাবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য এটি অগ্রহণযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, এই সভায় আফগানিস্তানের প্রতিনিধি দল প্রথমবার অংশগ্রহণ করেছে, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকি। মস্কো ফরম্যাটের মাধ্যমে আফগানিস্তানের আঞ্চলিক সংহতি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে।

বাগরাম বিমানঘাঁটির কৌশলগত গুরুত্ব

বাগরাম বিমানঘাঁটি আফগানিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি। কাবুল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ঘাঁটিতে দুটি কংক্রিট রানওয়ে রয়েছে, একটি ৩.৬ কিলোমিটার এবং অন্যটি ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের। আফগানিস্তানের পাহাড়ি ও দুর্গম ভূখণ্ডে বড় সামরিক বিমান ও অস্ত্রবাহী বিমান ওঠার জন্য সীমিত জায়গা রয়েছে। এ কারণে বাগরাম কৌশলগত দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

২০০১ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে বাগরাম বিমানঘাঁটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে, আফগানিস্তান, ভারত, চীন, পাকিস্তান এবং রাশিয়ার যৌথ অবস্থান স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, আফগান ভূখণ্ডে বাইরের কোনো সামরিক উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের দাবি এবং আফগানিস্তানের প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন যে, আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে পাঁচ বছর আগে স্বাক্ষরিত চুক্তির ভিত্তিতে বাগরাম বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রকে হস্তান্তর করতে হবে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘বাগরাম ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা এটি তালেবানকে বিনামূল্যে দিয়েছিলাম, এখন চাই বিমানঘাঁটি ফেরত পেতে।’

দুই দিন পরে ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, “যদি আফগানিস্তান বাগরাম বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ফেরত না দেয়, ভয়ানক ঘটনা ঘটতে পারে।” তবে তালেবান নেতারা এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রধান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘আফগানরা কখনোই তাদের ভূমি কাউকে হস্তান্তর করবে না।’

এ প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট। নয়াদিল্লি ট্রাম্পের দাবিকে সমর্থন না করে, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে বাগরামে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ‘অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আফগান মাটি এবং পার্শ্ববর্তী দেশের নিরাপত্তা সম্পর্কিত বক্তব্য মূলত পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে প্রকাশ করা হয়েছে।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা

মস্কো ফরম্যাটের যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, অংশগ্রহণকারীরা আফগানিস্তানকে স্বাধীন, একত্রিত ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য অটল সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তারা দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় স্তরে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আফগানিস্তানকে সমর্থন করার মাধ্যমে দ্রুত সময়ে সন্ত্রাসের উচ্ছেদ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আফগান মাটি প্রতিবেশী দেশ ও অন্যান্য দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকির উৎস না হয়। অংশগ্রহণকারীরা সন্ত্রাসকে আফগানিস্তান, অঞ্চলের এবং বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন

জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকরা বলছেন, আফগানিস্তানের সঙ্গে আঞ্চলিক দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিনিময় ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা এখানে গুরুত্ব পেয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র্যবিমোচন, কৃষি, শিক্ষা ও দুর্যোগ প্রতিরোধের মতো ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের অংশগ্রহণে আঞ্চলিক প্রকল্প উন্নয়নের আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে।

এই নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আফগানিস্তানকে স্বাধীন, টেকসই এবং শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করার পথ প্রশস্ত হবে। ভারতের লক্ষ্য হলো, আফগানিস্তানকে কৌশলগত এবং অর্থনৈতিকভাবে সুসংহত আঞ্চলিক অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।

মুত্তাকির ভারত সফর

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি এই সপ্তাহে ভারতের প্রথম সফরে যাচ্ছেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তাঁকে ৯ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত নয়াদিল্লি সফরের অনুমতি দিয়েছে। মুত্তাকি তালেবান নেতাদের জন্য প্রযোজ্য নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত হওয়ায় তাঁর এই অনুমতির প্রয়োজন ছিল।

এই সফরের মাধ্যমে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মুত্তাকির ভারত সফর আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত–চীন–পাকিস্তানের যৌথ অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নিয়ে এই অবস্থান আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্য এবং কূটনৈতিক প্রভাবকে প্রভাবিত করতে পারে।

মস্কো ফরম্যাটের সভায় আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার গুরুত্ব, সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগ, এবং আফগানিস্তানের স্বাধীনতা রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয়কে আরও দৃঢ় করবে।

আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দাবির বিরুদ্ধে ভারত–চীন–পাকিস্তান–রাশিয়া যৌথ অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করছে যে, আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা নীতিগতভাবে অগ্রাধিকার। মুত্তাকির ভারত সফর নতুন কূটনৈতিক অধ্যায় এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ভারত, চীন এবং পাকিস্তানের এই যৌথ অবস্থান আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক প্রভাব ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা নীতির উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের সংহত পদক্ষেপ আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয়, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

MAH – 13229 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button