কর্মসংস্থান

সহকারী জজ নিয়োগ গেজেট আটকে সাত মাস, বিচারব্যবস্থায় প্রভাব

Advertisement

বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থা মানেই দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতার প্রতীক। মামলাজট এবং বিচারিক কর্মসংস্থানের বিলম্ব দেশের নাগরিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়ায় বড় বাধা সৃষ্টি করছে। এই দীর্ঘসূত্রতার একটি নজির হলো ১৭তম সহকারী জজ নিয়োগের গেজেট প্রকাশ না হওয়া, যা ইতিমধ্যেই সাত মাস অতিক্রম করেছে।

১৭তম সহকারী জজ নিয়োগ: পেছনের গল্প

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন (বিজেএসসি) ২০২৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সহকারী জজ পদে ১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়া তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়—প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, এবং মৌখিক পরীক্ষা।

প্রাথমিকভাবে কমিশন গত বছরই প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন করেছিল। এরপর ২০২৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়। চূড়ান্ত ফলাফলের ঘোষণা হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে, যেখানে ১০২ জনকে সহকারী জজ পদে সাময়িকভাবে সুপারিশ করা হয়।

কিন্তু তবুও সাত মাস পরও তাদের নিয়োগের গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। তিন ধাপে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও প্রার্থীরা চাকরিতে যোগ দিতে পারছেন না। ফলে ব্যক্তিগত জীবনে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে এবং দেশের বিচারব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রার্থীদের প্রতিক্রিয়া

একজন পরীক্ষার্থী, যিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি, প্রথম আলোকে জানান, “আমাদের নিয়োগ বিলম্বিত হওয়ায় ব্যক্তিগত জীবনে যেমন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তেমনি দেশের বিচারব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিটি মামলার পেছনে আছে মানুষের ভোগান্তি, অপেক্ষা আর ন্যায়ের প্রত্যাশা। দেশে প্রায় ৪৬ লাখ মামলা বিচারাধীন। আমরা যদি দ্রুত যোগ দিতে পারি, তবে মামলার জট কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারব।”

অন্য একজন প্রার্থী বলেন, “বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ১৯ মাস পেরিয়ে গেছে। সুপারিশ পেয়েছি তা–ও সাত মাসের বেশি। এখনো বেকার বসে থাকায় নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে হচ্ছে। এখনো টিউশন করে চলতে হচ্ছে। আমরা শুধু আমাদের পেশাগত স্বপ্ন পূরণ করতে চাই, কিন্তু দীর্ঘসূত্রতা আমাদের জীবনকে জটিল করে তুলছে।”

কেন গেজেট আটকে আছে?

বিজেএসসি সূত্রে জানা গেছে, গেজেট প্রকাশে দেরি হওয়ার মূল কারণ হলো পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ার বিলম্ব। এছাড়া অন্যান্য প্রশাসনিক প্রক্রিয়াও সময় নিচ্ছে। কমিশন নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কখন পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া শেষ হবে।

গেজেট প্রকাশ না হওয়া মানে শুধু চাকরিতে যোগদানের বিলম্ব নয়, এটি দেশের বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতাকেও প্রভাবিত করছে। প্রতি বছর লাখ লাখ মামলা বিচারাধীন থাকে, এবং সহকারী জজদের দ্রুত নিয়োগ হলে মামলার জট কমানো সম্ভব।

বিচারব্যবস্থায় প্রভাব

বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থা দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিগত কয়েক বছর ধরেই আলোচনা ও সমালোচনার মুখে রয়েছে। ৪৬ লাখ মামলা বিচারাধীন থাকার পাশাপাশি বিচারিক কর্মকর্তা কম থাকার কারণে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না।

সহকারী জজ নিয়োগের বিলম্ব দেশের নাগরিকদের জন্য ন্যায়ের প্রাপ্যতায় বাধা সৃষ্টি করছে। যখন প্রার্থীরা দীর্ঘ সময় চাকরিতে যোগ দিতে পারেন না, তখন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি বাধাগ্রস্ত হয়। এই সমস্যা শুধুমাত্র বিচারপ্রার্থী বা নতুন নিয়োগপ্রার্থীকে নয়, পুরো দেশের বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে।

সরকারি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা

বিচার বিভাগের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত এবং স্বচ্ছ করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  1. পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ার দ্রুত সমাধান – প্রার্থীদের নিরাপত্তা যাচাই করা গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি সময়সাপেক্ষ হতে পারে। প্রক্রিয়াটিকে দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে।
  2. বিচারিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি – প্রার্থীদের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ, নির্ভুল ও সময়মতো হওয়া প্রয়োজন।
  3. অতিরিক্ত প্রশাসনিক স্টাফ নিয়োগ – কমিশন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে প্রক্রিয়া দ্রুত হয়।

অন্য দেশের তুলনা

পাশাপাশি, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের বিচারিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার তুলনা করলে দেখা যায়, অনেক দেশ প্রার্থীদের পরীক্ষা ও ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করে দ্রুত নিয়োগ প্রদান করে। ফলে মামলার জট কমানো সম্ভব হয় এবং বিচার ব্যবস্থা কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়।

প্রার্থীদের ভবিষ্যৎ ও আশঙ্কা

যারা ইতিমধ্যেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, তারা ব্যক্তিগত জীবন ও পেশাগত লক্ষ্য পূরণে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। অনেক প্রার্থী টিউশন বা অন্যান্য অস্থায়ী কাজ করে নিজের জীবন চালাচ্ছেন। এটি তাদের মানসিক চাপ বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের জন্য সম্ভাব্য দক্ষ বিচারিক কর্মকর্তাদের কাজের ক্ষতি ঘটাচ্ছে।

কিছু প্রার্থী মনে করছেন, দীর্ঘসূত্রতার এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তবে দেশের বিচারব্যবস্থা আরো ধীর এবং অকার্যকর হয়ে উঠবে। তাদের মতে, সহকারী জজদের দ্রুত নিয়োগ না হলে বিচারিক ব্যবস্থার মান হ্রাস পাবে।

সমাধানের দিকনির্দেশনা

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গেজেট বিলম্ব রোধে সরকারকে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান করা উচিত। এছাড়া কমিশনকে প্রার্থীদের নিয়মিত তথ্য দিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন রাখা প্রয়োজন।

এছাড়া, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া ও অন্যান্য প্রশাসনিক কাজ দ্রুত করা সম্ভব। এতে প্রার্থীরা চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন এবং দেশের বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা দ্রুত, নির্ভুল ও কার্যকর হতে হলে সহকারী জজ নিয়োগের গেজেট বিলম্ব অবিলম্বে সমাধান করা জরুরি। প্রার্থীরা শুধু তাদের পেশাগত স্বপ্ন পূরণ করতে চাচ্ছেন না, বরং দেশের নাগরিকদের জন্য ন্যায়ের প্রক্রিয়াও সহজ করতে চান।

প্রতিটি বিলম্বিত পদ শুধু প্রার্থীদের জীবনে প্রভাব ফেলছে না, বরং দেশের বিচারব্যবস্থার উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই সরকারি সংস্থা ও কমিশনের দ্রুত পদক্ষেপ অপরিহার্য।

MAH – 13224 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button