অর্থনীতি

সোনার দামে সর্বোচ্চ রেকর্ড, আউন্সপ্রতি ছাড়াল ৪০০০ ডলার

Advertisement

আন্তর্জাতিক বাজারে সর্বোচ্চ রেকর্ড, বাড়ছে বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা

আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আউন্সপ্রতি সোনার দাম বুধবার (৮ অক্টোবর ২০২৫) ছাড়িয়েছে ৪০০০ মার্কিন ডলার। এটাই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড। বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতি, ভূরাজনীতি ও সুদের হার–সংক্রান্ত অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা সোনাকে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।

ফলে শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীই নন, বড় বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ কিনছে। বাজারে এখন এমন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে—খুব শিগগিরই স্বর্ণের দাম আউন্সপ্রতি ৫০০০ ডলার ছুঁতে পারে।

আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার নতুন মাইলফলক

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে স্পট গোল্ডের (তাৎক্ষণিক লেনদেন হওয়া স্বর্ণ) দাম দাঁড়ায় আউন্সপ্রতি ৪,০১৭.১৬ ডলার। যা আগের দিনের তুলনায় প্রায় ০.৯ শতাংশ বেশি।

একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডিসেম্বরে সরবরাহযোগ্য ফিউচার চুক্তির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে আউন্সপ্রতি ৪,০৪০ ডলার। এভাবে টানা কয়েক মাস ধরে স্বর্ণের দাম বেড়ে চলায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও বেড়েছে।

কেন এত দ্রুত বাড়ছে সোনার দাম?

বিশ্লেষকদের মতে, একাধিক কারণ মিলে সোনার বাজারে এই অস্বাভাবিক উল্লম্ফন ঘটেছে।

  1. মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি
    ফেডারেল রিজার্ভ খুব শিগগির সুদের হার কমাবে বলে ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। সুদের হার কমলে শেয়ারবাজার বা বন্ডে মুনাফা কমে যায়। ফলে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিকল্প হিসেবে স্বর্ণে ঝুঁকে পড়েন।
  2. বৈশ্বিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা
    মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করেছে। এর প্রভাব পড়েছে সরাসরি স্বর্ণের চাহিদায়।
  3. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণ কেনা
    গত এক বছরে চীন, ভারত, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ কিনেছে। তারা নিজেদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে বৈচিত্র্যময় করতে চাইছে।
  4. দুর্বল মার্কিন ডলার
    বিশ্ববাজারে ডলারের মান কিছুটা কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের দিকে ঝুঁকেছেন। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, ডলার দুর্বল হলে স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকে।
  5. বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্ব
    বাজারে এখন “ফিয়ার অব মিসিং আউট” বা সুযোগ হারানোর ভয়ে বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি করে সোনা কিনছেন।

২০২৫ সালে স্বর্ণের দামের প্রবণতা

এই বছর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত স্বর্ণের দাম বেড়েছে প্রায় ৫৩ শতাংশ। ২০২৪ সালেও এটি বেড়েছিল ২৭ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের ধারাবাহিক বৃদ্ধি বিশ্ববাজারে স্বর্ণকে অভূতপূর্ব উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

তাই ওয়াং নামের এক স্বাধীন ধাতু ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, “ফেডারেল রিজার্ভ যদি ধারাবাহিকভাবে সুদ কমাতে থাকে, তবে স্বর্ণের দাম আরও অনেক উঁচুতে যাবে। আস্থা এখন একেবারেই স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে আছে।”

তবে তিনি সতর্ক করেছেন, যদি মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি হয় বা ইউক্রেন যুদ্ধে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়, তাহলে স্বর্ণের দাম সাময়িকভাবে কিছুটা কমে যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ঋণের চাপ, ডলারের দুর্বলতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণকেন্দ্রিক নীতি দামকে উঁচুতেই রাখবে।

যুক্তরাষ্ট্রে সরকার বন্ধ ও অর্থনৈতিক প্রভাব

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টানা সাত দিন ধরে সরকার বন্ধ (Shutdown) থাকায় গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিনিয়োগকারীরা সরকারি তথ্যের পরিবর্তে বিকল্প উৎসের ওপর নির্ভর করছেন।

বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ফেড অক্টোবরের বৈঠকে ০.২৫ শতাংশ সুদ কমাতে পারে। ডিসেম্বরে আরও এক দফা সুদ কমানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

কেসিএম ট্রেডের প্রধান বিশ্লেষক টিম ওয়াটারার বলেন, “অর্থনীতি ও রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে স্বর্ণের দাম বেড়ে যায়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও সরকার বন্ধের কারণে স্বর্ণের পক্ষে পরিস্থিতি একেবারেই অনুকূল।”

শুধু স্বর্ণ নয়, বেড়েছে অন্যান্য ধাতুর দামও

সোনার পাশাপাশি অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর দামও বেড়েছে।

  • রূপা (Silver): আউন্সপ্রতি ৪৮.৪৪ ডলার (১.৩% বৃদ্ধি)
  • প্লাটিনাম (Platinum): আউন্সপ্রতি ১,৬৫৭.৩৩ ডলার (২.৪% বৃদ্ধি)
  • প্যালাডিয়াম (Palladium): আউন্সপ্রতি ১,৩৬৮.৬৮ ডলার (২.৩% বৃদ্ধি)

এতে বোঝা যাচ্ছে, শুধু সোনা নয়, পুরো মূল্যবান ধাতুর বাজারেই এক ধরনের ইতিবাচক ধারা তৈরি হয়েছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: আউন্সপ্রতি ৫০০০ ডলার?

বিশ্লেষকদের অনেকেই ধারণা করছেন, খুব শিগগিরই স্বর্ণের দাম আউন্সপ্রতি ৫০০০ ডলার ছুঁতে পারে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি আরও সুদের হার কমায় এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে, তবে সোনার দাম আরও দ্রুত বাড়তে পারে।

বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসইউবিএস সম্প্রতি তাদের পূর্বাভাস বাড়িয়েছে। তারা মনে করছে, আগামী কয়েক বছর সোনার দাম উচ্চ পর্যায়ে স্থায়ী হতে পারে।

বাংলাদেশে প্রভাব কেমন হবে?

আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়লে তার প্রভাব সরাসরি পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। ইতিমধ্যেই দেশের বাজারে ভরি প্রতি সোনার দাম একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈশ্বিক বাজারে উল্লম্ফন চলতে থাকলে স্থানীয় বাজারেও দাম আরও বাড়তে পারে। তবে চাহিদা কমে গেলে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসতে পারে।

বাংলাদেশের সাধারণ ক্রেতারা অবশ্য এই দামবৃদ্ধিকে “অসহনীয়” বলে মনে করছেন। অনেকেই সোনার গহনা কেনার পরিকল্পনা স্থগিত করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই প্রবণতা চলতে থাকে তবে দেশের গহনা শিল্পেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

স্বর্ণকে যুগে যুগে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি যত অনিশ্চিত, ভূরাজনীতি যত জটিল হচ্ছে—সোনা ততই বিনিয়োগকারীদের কাছে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠছে। ২০২৫ সালে আউন্সপ্রতি ৪০০০ ডলারের নতুন মাইলফলক প্রমাণ করছে, স্বর্ণ এখনও বিশ্ব অর্থনীতির “চিরন্তন আশ্রয়স্থল”।

তবে বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, স্বল্পমেয়াদে দামের ওঠানামা হতে পারে। তাই বিনিয়োগের আগে ভালোভাবে বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা জরুরি।

MAH – 13220 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button