বিশ্ব

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের দুই বছরে আর্থিক ক্ষতি ৬৮০০ কোটি ডলার!

Advertisement

দুই বছরের লাগাতার ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজা উপত্যকা আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। জাতিসংঘ ও স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি হামলায় গাজার অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে অন্তত ৬ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারে। ধ্বংস হয়েছে ৯০ শতাংশের বেশি স্থাপনা, হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।

ইসরাইলি হামলায় গাজার ধ্বংসযজ্ঞ

দুই বছরে গাজার নগরীগুলোতে বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণে ভেঙে পড়েছে হাজার হাজার ভবন। গাজার প্রশাসন জানিয়েছে, আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। কেবল আবাসন খাতেই ক্ষতি হয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ। প্রায় ২ লাখ ৯২ হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, যা মোট অবকাঠামোগত ক্ষতির অর্ধেকেরও বেশি।

গাজার ধর্ম মন্ত্রণালয় জানায়, ইসরাইলি হামলায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে অন্তত ৮৩৪টি মসজিদ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত আরও ২৭৫টি। এছাড়া গাজার তিনটি ঐতিহাসিক গির্জাও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। শুধু তাই নয়, ৬০টি কবরস্থানের মধ্যে ৪০টিতে হামলা চালানো হয়, যার মধ্যে ২১টি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতের ভয়াবহ বিপর্যয়

হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোও রক্ষা পায়নি এই আগ্রাসন থেকে। গত দুই বছরে গাজার প্রায় ৯০ শতাংশ স্বাস্থ্য অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে পুরো উপত্যকায় কার্যকর আছে মাত্র ১৪টি হাসপাতাল—এর মধ্যে ৮টি গাজা সিটিতে, বাকি ৬টি দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনিস এলাকায়। এসব হাসপাতালে রোগীর চাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে; অনেকেই তাঁবু বা হাসপাতালের করিডরে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অপারেশন থিয়েটার ও আইসিইউ ইউনিটের বড় অংশ অকেজো। ফলে প্রতিদিন অসংখ্য আহত ও অসুস্থ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে চিকিৎসার অভাবে।

অর্থনৈতিক সংকট ও পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ

গাজার স্থানীয় প্রশাসনের হিসাবে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অঞ্চলটির অর্থনীতি প্রায় ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হয়েছে। শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিখাত কার্যত বন্ধ। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজাকে পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধারে অন্তত ৫৩০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এর মধ্যে আবাসন পুনর্গঠনে লাগবে তিন হাজার কোটি ডলার এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ও বাণিজ্য পুনরুদ্ধারে দরকার আরও দুই হাজার কোটি ডলার।

এছাড়া, গাজার পরিবহন ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ ও টেলিকম খাতও পুরোপুরি বিপর্যস্ত। পুনর্গঠনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।

হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের সূত্রপাত

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের আকস্মিক আক্রমণের পর ইসরাইল গাজায় তীব্র সামরিক অভিযান শুরু করে। এরপর থেকে চলতে থাকে বিমান হামলা, স্থল অভিযান ও অবরোধ। ইসরাইল দাবি করে, এটি “সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান”, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এটি ছিল স্পষ্ট গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের প্রচেষ্টা।

এই দুই বছরে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন এক লাখ সত্তর হাজারেরও বেশি মানুষ। নিখোঁজ রয়েছেন আরও হাজারো মানুষ, যাদের অনেকেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবিক সংকট

জাতিসংঘ, রেডক্রস ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজাকে এখন বিশ্বের অন্যতম বড় মানবিক বিপর্যয় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ত্রাণ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ঢোকাতে বাধা দিচ্ছে ইসরাইল, ফলে সেখানে খাদ্য ও পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। লক্ষাধিক শিশু অপুষ্টি ও মানসিক আঘাতে ভুগছে।

জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ বার্তায় বলা হয়েছে, “গাজায় মানবিক বিপর্যয় রোধে বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।”

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সানাম ভাকিল বলেন, “দুই বছর ধরে ইসরাইল গাজায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, কিন্তু তারা কী অর্জন করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। বরং এ আগ্রাসন ইসরাইলকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন করেছে।” তিনি আরও যোগ করেন, “গাজায় এমন একটি জীবনব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যা স্থানীয়দের অস্তিত্বের জন্য হুমকি তৈরি করেছে।”

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ইসরাইলের এই অভিযানের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে পড়েছে। এমনকি ইরান, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশ এখন এই সংঘাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।

দুই বছরের ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজা এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত। অবকাঠামো, অর্থনীতি ও মানবিক জীবনে এমন ভয়াবহ ক্ষতির নজির আধুনিক ইতিহাসে বিরল। বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া গাজার পুনর্গঠন অসম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—বিশ্ব কি এখনো গাজার জন্য যথেষ্ট কিছু করছে?

এম আর এম – ১৬৫৮,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button