
বাংলাদেশের কারাগার ব্যবস্থা নতুন যুগে প্রবেশের মুখে। দেশের কারাগারগুলিকে শুধুমাত্র বন্দী রাখার স্থান হিসেবে না রেখে, একটি সংশোধনাগার বা কারেকশনাল সেন্টার হিসেবে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন।
মোতাহের হোসেনের দাবি, শুধু জেলের নাম পরিবর্তন করলেই বা নতুন আইন প্রণয়ন করলেই বন্দীদের জীবন মান বা সংশোধনের ধারা উন্নত হবে না। বরং প্রয়োজন সামগ্রিক কাঠামোগত সংস্কার, শিক্ষা, ট্রেনিং ও পুনর্বাসন কার্যক্রম, এবং নিয়মিত মনিটরিং ও দক্ষ কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ।
বাংলাদেশের কারাগার এখন কেন পরিবর্তনের পথে?
বাংলাদেশে কারাগার ব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন ধরে পুরনো আইন ও অনিয়মে পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৮৬৪ সালের জেলকোড এখনও প্রায় সব কারাগারের নিয়ন্ত্রণে প্রযোজ্য। এই নিয়মের কারণে বন্দীদের পুনর্বাসন কার্যক্রম প্রায় শূন্য পর্যায়ে রয়েছে।
সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন জানান, “আগে ধারণা ছিল যে, মানুষকে শাস্তি দিয়ে সংশোধন করতে হবে। কিন্তু এ ধারা কার্যকর হয়নি। যারা অত্যন্ত জটিল মানসিকতার, তারা শাস্তি দ্বারা আরও বেশি বিপর্যস্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে। আমরা মোটিভেশন, কাউন্সেলিং, ট্রেনিং এবং রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে বন্দীদের পুনর্বাসন করতে চাই।”
তিনি আরও বলেন, “জেলের নাম পরিবর্তন বা আইন সংশোধনের পাশাপাশি আমরা বন্দীদের জন্য নতুন প্রভিশন তৈরি করছি। এর মাধ্যমে আমরা তাদের সামাজিক জীবনে পুনঃসংযোজনের সুযোগ দিতে চাই।”
কারাগার থেকে সংশোধনাগারে রূপান্তর
কারেকশনাল সার্ভিস অ্যাক্ট-২০২৫ এর খসড়া ইতিমধ্যেই প্রস্তুত। এর মূল লক্ষ্য হল কারাগারকে শুধু শাস্তির স্থান নয়, সংশোধনের কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তর করা। এর মধ্যে রয়েছে:
- ওপেন জেল ধারণা: বন্দীরা বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করবে এবং সম্মানী পাবে।
- ট্রেনিং ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম: বন্দীরা পেশাগত ও সামাজিক দক্ষতা অর্জন করবে।
- কারেকশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক: যেখানে বন্দীরা উৎপাদনশীল কাজ করবে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে।
মোতাহের হোসেন বলেন, “এই উদ্যোগ সম্পূর্ণ হলে, বাংলাদেশ জেল প্রথাগত বন্দিশিবির থেকে একটি কার্যকর সংশোধনাগারে রূপান্তরিত হবে।”
বন্দীসংখ্যা ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে দেশের ৭৪টি কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তা সমস্যা তৈরি হয়েছে।
তিনি জানান, “প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ৬৮টি কারাগারের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৭৪ করা হয়েছে। ১৫টি কেন্দ্রীয় এবং ৫৯টি জেলা কারাগার রয়েছে। অতি পুরোনো ১৭টি কারাগারের মধ্যে চারটির পুনর্নির্মাণ কাজ চলছে। বাকি কারাগারগুলোর সম্প্রসারণ ও রিবিল্ড ধাপে ধাপে করা হবে।”
তবে মোতাহের হোসেন বলেন, “শুধু কাঠামো বাড়ানোই যথেষ্ট নয়। বন্দীর সংখ্যা কমানো ও বিচারাধীন বন্দীদের দ্রুত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। আমরা চাই বন্দীরা প্রোডাক্টিভ মোডে থাকুক। এতে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং সামাজিক পুনর্বাসনের সব সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে।”
দুর্ঘটনা ও বিদ্রোহ পর্যালোচনা
গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের সময় কয়েকটি কারাগারে বিদ্রোহ ঘটে। বন্দীরা অস্ত্র লুট করে আগুন দেয় এবং কিছু পালিয়ে যায়।
মোতাহের হোসেন জানান, “আমরা প্রতিটি ঘটনাকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করেছি। মূল সমস্যা ছিল ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল দুর্বলতা এবং কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর দক্ষতার অভাব। আমরা এখন নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও নজরদারি বাড়িয়েছি। পাশাপাশি নতুন ফিউচার প্রজেক্টে এই দুর্বলতা দূর করা হবে।”
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ
কারাগারে মাদকদ্রব্য প্রবেশ ও সেবনের অভিযোগ দীর্ঘদিন থেকে বিদ্যমান।
তিনি বলেন, “আমরা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। গত বছরে ২৯ জন কারারক্ষীকে মাদক সেবন ও বহনে জড়িত থাকার জন্য চাকরিচ্যুত করেছি। এছাড়া সব কারাগারে মাদকবিরোধী অভিযান, কাউন্সেলিং এবং সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে।”
নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও প্রযুক্তির ব্যবহার
শীর্ষ সন্ত্রাসী বা আলোচিত বন্দীরা কখনও কারাগার থেকে ফোন ব্যবহার করে অপরাধ পরিচালনার অভিযোগও ছিল।
মোতাহের হোসেন বলেন, “এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার এবং নিয়মিত তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছি। বিশেষ নজরদারির জন্য CCTV, GPS ট্র্যাকিং এবং RFID কন্ট্রোল ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে। এতে ভবিষ্যতে এই ধরনের অভিযোগ কমবে।”
দূর্ণীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ
কারাগারে দূর্নীতি ও অবৈধ লেনদেন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
- ১২ জন সিনিয়র কর্মকর্তা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
- ৩৪ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
- ৪৪০ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা।
- ১৭২ জনকে কঠোর শর্তে বদলি করা হয়েছে।
“যারা ভালো কাজ করছেন, তাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে আমরা কারাগার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও ন্যায়পরায়ণতা আনতে চাই,” যোগ করেন মোতাহের হোসেন।
বন্দীর ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ
গতকালের উদাহরণে দেখা গেছে, কারাবন্দী থাকার সময় কেউ কেউ পরিবার গঠন করেছে বা বিশেষ সুযোগ নিয়েছে। তবে বর্তমান পদক্ষেপে সিসিটিভি, জিপিএস ট্র্যাকিং ও আরএফআইডি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
- নতুন আইন ও কাঠামোগত সংস্কার: কারাগারকে সম্পূর্ণ সংশোধনাগারে রূপান্তরিত করা।
- প্রশিক্ষণ ও কাউন্সেলিং: বন্দী ও কর্মকর্তা উভয়কে দক্ষ করা।
- মাদক, দুর্নীতি ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ: জিরো টলারেন্স নীতি।
- প্রোডাক্টিভ কার্যক্রম: বন্দীদের উৎপাদনশীল ও দক্ষ বানানো।
মোতাহের হোসেনের মতে, “এই উদ্যোগ সফল হলে বাংলাদেশ জেল ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের সংশোধনাগারে পরিণত হবে, যেখানে বন্দীর মানবিক অধিকার ও সামাজিক পুনর্বাসন নিশ্চিত হবে।”
বাংলাদেশের কারাগার ব্যবস্থার রূপান্তর এখন এক বাস্তবতা। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোতাহের হোসেনের নেতৃত্বে নতুন আইন, প্রযুক্তি ও মানবিক উদ্যোগের সমন্বয় বন্দীদের জীবনমান ও সমাজে পুনর্বাসনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু শাস্তি নয়, সংশোধন ও পুনর্বাসন এখন বাংলাদেশের কারাগারের মূলমন্ত্র।
MAH – 13208 I Signalbd.com