
সেনা মোতায়েন ইস্যুতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইলিনয়েস অঙ্গরাজ্যের মামলা
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ফের উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত। ইলিনয়েস অঙ্গরাজ্যে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়ায় রাজ্য প্রশাসন তাঁর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করেছে।
ইলিনয়েসের গভর্নর জে. বি. প্রিৎজকার সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ট্রাম্প সংবিধানবিরোধীভাবে ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে শিকাগো এবং ইলিনয়েসে সেনা মোতায়েন করেছেন। তাঁর মতে, এটি শুধু সংবিধান লঙ্ঘনই নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ।
ট্রাম্পের সেনা মোতায়েনের নির্দেশ
গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথকে নির্দেশ দেন— ইলিনয়েসে ন্যাশনাল গার্ডের ৩০০ সদস্য মোতায়েন করতে। পরে টেক্সাস থেকে আরও ৪০০ সেনা সদস্যকে শিকাগো ও আশপাশের এলাকায় পাঠানো হয়।
প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন, অভিবাসন সংকট, অপরাধ বৃদ্ধি এবং স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি সামলাতেই এই মোতায়েন প্রয়োজন। তবে সমালোচকদের মতে, এটি নিছক ডেমোক্রেটিক পার্টিকে চাপে রাখার কৌশল।
সংবিধান ও ইনসারেকশন অ্যাক্ট ১৭৯২
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট বিশেষ পরিস্থিতিতে সেনা মোতায়েন করতে পারেন। ইনসারেকশন অ্যাক্ট ১৭৯২ নামে পরিচিত আইনে বলা হয়েছে— কোনো অঙ্গরাজ্যে যদি চরম অস্থিরতা বা বিদ্রোহ দেখা দেয়, তবে প্রেসিডেন্ট সেখানে সেনা পাঠাতে পারেন।
তবে ইলিনয়েস প্রশাসনের দাবি, বর্তমান পরিস্থিতি কখনোই বিদ্রোহ বা যুদ্ধ পরিস্থিতির পর্যায়ে পৌঁছেনি। সুতরাং এই সিদ্ধান্ত বেআইনি এবং সাংবিধানিক সীমার বাইরে।
ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্য
শিকাগো সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্রিফিংয়ে বলেন— “শিকাগো এখন যুদ্ধক্ষেত্র, নরকের গর্ত এবং বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক শহরগুলোর একটি।”
এই মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। গভর্নর প্রিৎজকার ও শিকাগোর মেয়র ব্র্যান্ডন জনসন বলেন, এমন ভাষা ব্যবহার করে ট্রাম্প আসলে শহরের মানুষকে অপমান করেছেন এবং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চাইছেন।
অভিবাসন নীতিতে কঠোরতা
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অভিবাসন ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের পর তিনি প্রথমেই একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন, যেখানে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর থেকেই মার্কিন কাস্টমস ও পুলিশ বাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করে। অভিবাসীদের গ্রেপ্তার ও বহিষ্কারে সহযোগিতা করতেই সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো হচ্ছে বলে জানায় প্রশাসন।
ইলিনয়েসের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ইলিনয়েস দীর্ঘদিন ধরেই ডেমোক্রেটিক পার্টির শক্ত ঘাঁটি। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্মভূমি এই অঙ্গরাজ্য। ফলে ট্রাম্পের সেনা মোতায়েনকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছে অনেকে। সমালোচকদের দাবি, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ডেমোক্র্যাট-শাসিত রাজ্যে সেনা পাঠিয়ে নিজের রিপাবলিকান সমর্থকদের সন্তুষ্ট করতে চাইছেন।
মার্কিন রাজনীতিতে উত্তেজনা
এই ঘটনাকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ডেমোক্রেটিক নেতারা বলছেন, সেনা মোতায়েন মূলত ফেডারেল সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার। রিপাবলিকান নেতারা আবার যুক্তি দিচ্ছেন— ইলিনয়েসে অপরাধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তাই এই পদক্ষেপ যৌক্তিক।
অপরাধ ও সহিংসতার চিত্র
শিকাগো শহর বহুদিন ধরেই অপরাধপ্রবণ নগরী হিসেবে কুখ্যাত। অস্ত্র সহিংসতা, মাদক ব্যবসা এবং গ্যাং কালচার শহরটিকে বারবার অস্থির করেছে। তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে, সেনা মোতায়েন নয়— শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সংস্কার ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
ইতিহাসে সেনা মোতায়েনের নজির
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একাধিকবার প্রেসিডেন্টরা সেনা মোতায়েন করেছেন।
- ১৯৫৭ সালে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সেনা পাঠান আর্কানসাসে।
- ১৯৬৭ সালে ডেট্রয়েট দাঙ্গায় সেনা মোতায়েন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জনসন।
- ১৯৯২ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে দাঙ্গার সময় প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়র সেনা ব্যবহার করেন।
তবে সমালোচকদের মতে, ট্রাম্পের বর্তমান পদক্ষেপ এসব উদাহরণের সঙ্গে মেলে না, কারণ ইলিনয়েসে এখনো বড় ধরনের বিদ্রোহ বা সশস্ত্র সহিংসতা দেখা যায়নি।
মামলার সম্ভাব্য পরিণতি
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতে এই মামলা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। আদালত যদি সিদ্ধান্ত দেয় যে ট্রাম্প সাংবিধানিক সীমা অতিক্রম করেছেন, তবে এটি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ওপর বড় ধাক্কা হতে পারে। আবার যদি আদালত ট্রাম্পের পক্ষে রায় দেয়, তবে ভবিষ্যতে যেকোনো প্রেসিডেন্ট সহজেই সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
ট্রাম্প বনাম ডেমোক্র্যাট রাজ্যসমূহ
ট্রাম্পের সঙ্গে ডেমোক্র্যাট শাসিত রাজ্যগুলোর দ্বন্দ্ব নতুন নয়। নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া ও ইলিনয়েস প্রায়শই তাঁর নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। করোনা মহামারির সময়ও এসব রাজ্য ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনা করেছিল। এবার সেনা মোতায়েনের ইস্যুতে বিরোধ নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
ইলিনয়েসে সেনা মোতায়েন ইস্যুতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিতর্ক তীব্র আকার ধারণ করেছে। একদিকে প্রেসিডেন্ট দাবি করছেন, জাতীয় নিরাপত্তা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাঁর সিদ্ধান্ত জরুরি; অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট নেতারা বলছেন, এটি নিছক রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং সংবিধান লঙ্ঘন।
আগামী দিনে আদালতের রায় ও রাজনৈতিক চাপ— উভয়ই নির্ধারণ করবে এই বিতর্ক কোন দিকে গড়াবে। তবে এতটুকু স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ২০২৫ সালের শেষ ভাগে এসে আরও অস্থির ও বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
MAH – 13201 I Signalbd.com