
মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত আবারও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মিসরের পর্যটন নগরী শারম আল শেখে যুদ্ধবিরতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চললেও, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা থামেনি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চালানো হামলায় অন্তত ১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে তিনজন ছিলেন খাদ্য ও ত্রাণ সংগ্রহ করতে যাওয়া সাধারণ মানুষ।
আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, আলোচনার মধ্যেই গাজায় সীমিত আকারে অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। তবে গাজার বাসিন্দাদের দাবি, এই “সীমিত” অভিযানেও প্রতিদিন প্রাণহানি ঘটছে। গত তিন দিনে শুধু গুলিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ১০৪ জন ফিলিস্তিনি।
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন একটি যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ইসরায়েল দ্রুতই সেই প্রস্তাব সমর্থন জানায়। পরে ৩ অক্টোবর গাজা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসও প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। এর পরপরই ট্রাম্প ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে আহ্বান জানান— যেন গাজায় হামলা বন্ধ করা হয়।
নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, আইডিএফকে অভিযান বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে গাজায় বোমাবর্ষণ ও গুলি চলছেই। ফলে যুদ্ধবিরতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক মহলে।
ইসরায়েলি সরকারের মুখপাত্র শোশ বেদ্রোসিয়ান দাবি করেছেন, ট্রাম্প আহ্বান জানানোর পর থেকে ইসরায়েল কেবল “রক্ষণাত্মক” অভিযান চালাচ্ছে। তবে গাজার হাসপাতালগুলোয় প্রতিদিন যে লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে, তা এই ব্যাখ্যার সঙ্গে মেলে না।
শারম আল শেখে আলোচনার অগ্রগতি
সোমবার শারম আল শেখে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, কাতার, মিসর ও হামাসের প্রতিনিধিরা বৈঠকে বসেন। মিসরের দৈনিক আল কাহেরা নিউজ জানিয়েছে, আলোচনার প্রথম সেশনে মূলত দুইটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আলোচনা হয়:
- গাজায় আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি
- ইসরায়েলের কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি
এখনও যুদ্ধবিরতির শর্তাবলী বা দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চুক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুরু হয়নি। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, উভয় পক্ষই এখনও কঠোর অবস্থানে আছে।
রক্তাক্ত ইতিহাসের বার্ষিকী
আজ ৭ অক্টোবর। ঠিক দুই বছর আগে, ২০২৩ সালের এই দিনে হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলের ভেতরে আকস্মিক আক্রমণ চালায়। সেই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।
হামলার পরপরই গাজায় ব্যাপক অভিযান শুরু করে আইডিএফ। দুই বছর ধরে চলা এই অভিযানে নিহত হয়েছেন ৬৭ হাজার ১৬০ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৯ জন। এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
গাজার মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ
গাজার পরিস্থিতি এখন চরম মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী:
- গাজার অধিকাংশ হাসপাতাল কার্যত অকেজো হয়ে পড়েছে।
- ওষুধ, বিদ্যুৎ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মারাত্মক সংকট চলছে।
- অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য পাচ্ছেন না।
- জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার প্রায় ২০ লাখ মানুষের মধ্যে ১৫ লাখ মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ২১ শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটগুলোর একটি।
যুদ্ধবিরতি কি সম্ভব?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া কঠিন। ইসরায়েল এখনও নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা বলছে, আর হামাস তাদের রাজনৈতিক দাবি থেকে সরে আসতে চাইছে না।
তবে মধ্যস্থতাকারীরা আশা করছেন, শারম আল শেখ বৈঠক অন্তত অস্থায়ী একটি সমঝোতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। প্রথম ধাপে জিম্মি বিনিময় এবং ত্রাণ কার্যক্রমে সমঝোতা হলে পরবর্তী সময়ে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চুক্তির পথ খুলে যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক চাপ ও ভবিষ্যৎ
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লীগসহ বিশ্ব নেতারা গাজায় নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অনেক দেশ ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতি মানতে এবং হামাসকে সহিংসতা বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছে।
কিন্তু মাটির বাস্তবতা ভিন্ন। গাজার মানুষ প্রতিদিনই মরছে, শিশু ও নারী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, উভয় পক্ষকেই এখন রাজনৈতিক সমঝোতার টেবিলে আসতেই হবে, নইলে এই রক্তক্ষয়ী সংঘাত থামবে না।
গাজার আকাশে যুদ্ধবিমান এখনও ঘুরছে, আর শারম আল শেখে কূটনীতিকরা শান্তির কথা বলছেন। দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাত ফিলিস্তিনকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। যুদ্ধবিরতির আলোচনার মাঝেও হামলা চলতে থাকলে, গাজার সাধারণ মানুষ আর কোনো আশার আলো দেখতে পাবে না।
আন্তর্জাতিক মহল বলছে— সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। যদি এখনই যুদ্ধ থামানো না যায়, তবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় হয়তো ইতিহাসে “গাজা ট্র্যাজেডি” নামে লিপিবদ্ধ হবে।
MAH – 13199 I Signalbd.com