বাংলাদেশ

ইউনূস-আইসেস্কো বৈঠক: শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে নতুন দিগন্ত

Advertisement

বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয়

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ইসলামিক ওয়ার্ল্ড এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (আইসেস্কো)-এর মহাপরিচালক ড. সালিম এম. আল মালিক সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

বৈঠকে দুই পক্ষ শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং তরুণদের ক্ষমতায়ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। বিশেষ করে প্রফেসর ইউনূসের বিশ্বখ্যাত থ্রি জিরো তত্ত্বশূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ—কে আইসেস্কোর ভবিষ্যৎ কৌশলগত পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আনেন ড. আল মালিক।

ড. সালিম আল মালিকের শ্রদ্ধা ও অভিভূত স্মৃতিচারণ

আইসেস্কো মহাপরিচালক বৈঠকের শুরুতেই প্রফেসর ইউনূসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন—

“আমি যখন চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্র ছিলাম, তখন প্রথম আপনার নাম শুনেছিলাম। বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ মডেল আমার কাছে ছিল অনুপ্রেরণার মতো। আপনার থ্রি জিরো ভিশন শুধু ব্যাংকিং নয়, পরিবেশ ও খেলাধুলার মতো বিভিন্ন খাতে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। আজ আপনার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে পেরে আমি গর্বিত।”

বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচির প্রতি সমর্থন

প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচিকে অভিনন্দন জানিয়ে ড. আল মালিক বলেন, বাংলাদেশে তার সফরকালে তিনি বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছেন এবং সংস্কারের নানা উদ্যোগ সম্পর্কে জেনেছেন।

তিনি উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশের এই পরিবর্তন ও নতুন দিকনির্দেশনা শুধু দেশটির জন্য নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও একটি অনুপ্রেরণা।”

আইসেস্কোর কৌশলে থ্রি জিরো তত্ত্ব

ড. আল মালিক বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব করেন যে, প্রফেসর ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্ব আইসেস্কোর শিক্ষা, যুব উন্নয়ন ও পরিবেশ বিষয়ক কৌশলের সঙ্গে যুক্ত হবে।

তিনি বলেন—

“আমরা চাই আপনার স্বপ্নকে আইসেস্কোর মূল কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ করতে। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মিশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য অপচয় কমানো এবং টেকসই সামাজিক ব্যবসায় মডেল আমাদের প্রধান লক্ষ্য।“

আইসেস্কোর কার্যক্রম ও অর্জন

ড. আল মালিক জানান, আইসেস্কো বর্তমানে সদস্য দেশগুলোতে টেকসই উন্নয়ন ও উদ্ভাবনী শিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা করছে।

  • ব্রুনেই, আলজেরিয়া ও নাইজেরিয়ায় সামাজিক ব্যবসা মডেলে উদ্যোক্তা কার্যক্রমকে রূপান্তর করা হয়েছে।
  • শিক্ষা ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু করা হয়েছে।
  • খাদ্য অপচয় কমানো ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রচারে সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা করা হচ্ছে।

প্রফেসর ইউনূসের প্রতিক্রিয়া

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আইসেস্কোর কাজের প্রশংসা করে বলেন—
“আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে টেকসই উন্নয়ন, সামাজিক ব্যবসা এবং পরিবেশ রক্ষার শিক্ষা দিতে হবে। আইসেস্কো যে ভূমিকা পালন করছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি আশা করি আমরা একসঙ্গে কাজ করে যুব সমাজকে উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও সামাজিক ব্যবসায় যুক্ত করতে পারব।”

বৈঠকে উপস্থিতি

বৈঠকে শিক্ষা উপদেষ্টা প্রফেসর সি. আর. আবরার উপস্থিত ছিলেন। তিনি শিক্ষা সংস্কার, উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে মতামত দেন।

প্রেক্ষাপট: মুহাম্মদ ইউনূস ও তার থ্রি জিরো তত্ত্ব

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। ক্ষুদ্রঋণ ও গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষকে ঋণ দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।

তার থ্রি জিরো ভিশন হলো—

  1. শূন্য দারিদ্র্য – এমন একটি পৃথিবী যেখানে কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না।
  2. শূন্য বেকারত্ব – সবার জন্য সৃজনশীল কর্মসংস্থান।
  3. শূন্য কার্বন নিঃসরণ – পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও টেকসই জীবনধারা।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই এই তত্ত্বকে গবেষণা ও উন্নয়ন কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

আইসেস্কো: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

আইসেস্কো (ICESCO) ১৯৭৯ সালে মরক্কোর ফেজ শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (OIC) অধীনস্থ একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ৫০টিরও বেশি দেশ এর সদস্য।

সংস্থার মূল লক্ষ্য হলো—

  • শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির উন্নয়ন
  • যুব সমাজের ক্ষমতায়ন
  • টেকসই উন্নয়নকে সমর্থন
  • সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে জ্ঞান ও গবেষণা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা

বাংলাদেশ-আইসেস্কো সম্পর্ক

বাংলাদেশ আইসেস্কোর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটি সংস্থার নানা শিক্ষা ও বিজ্ঞান কর্মসূচিতে যুক্ত রয়েছে।

  • বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আইসেস্কো বৃত্তি ও প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করেছে।
  • দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশনে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে।
  • জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গবেষণা সহযোগিতা করছে।

এই বৈঠককে তাই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, কারণ এটি বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি খাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন পথ খুলে দিতে পারে।

বিশ্লেষণ: কেন এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ

  1. শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা – বাংলাদেশের শিক্ষা খাত দ্রুত বদলাচ্ছে। এখানে আইসেস্কোর সহায়তা ভবিষ্যতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
  2. টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ – জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রফেসর ইউনূসের ‘থ্রি জিরো তত্ত্ব’ যদি আইসেস্কো গ্রহণ করে, তবে বৈশ্বিক সমর্থন বাড়বে।
  3. তরুণদের ক্ষমতায়ন – সামাজিক ব্যবসার মডেলকে কেন্দ্র করে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হতে পারে।
  4. আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি – প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বৈশ্বিক ইমেজ আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ দিগন্ত

এই বৈঠক প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, বৈশ্বিক পর্যায়েও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ নিয়ে আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আইসেস্কোর সহায়তায় বাংলাদেশে হতে পারে—

  • শিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ
  • নবায়নযোগ্য জ্বালানির গবেষণা কেন্দ্র
  • আন্তর্জাতিক শিক্ষাবিনিময় কর্মসূচি
  • তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সামাজিক ব্যবসা ইনকিউবেটর

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এই সৌজন্য সাক্ষাৎ কেবল আনুষ্ঠানিক বৈঠক নয়, বরং ভবিষ্যতের এক সম্ভাবনার দরজা। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আইসেস্কোর আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক একত্রে কাজ করলে বাংলাদেশ শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও পরিবেশ খাতে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবে।

MAH – 13195 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button