
যশোরে নির্মাণাধীন একটি ভবন থেকে বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে ২৮ বছর বয়সী সাজ্জাদ হোসেনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। রোববার (৫ অক্টোবর) বিকেলে শহরের শাহ আব্দুল করীম সড়কের রূপকথা মোড়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত সাজ্জাদ হোসেন যশোর সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের মঠবাড়ি গ্রামের আজগর হোসেনের ছেলে। তিনি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ‘একসেনচিউর নীলাচল টাওয়ার’-এ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সাজ্জাদ সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই কাজ করছিলেন। তিনি ক্রেন ব্যবহার করে ভবনের ১০ তলায় বালু তোলা ও ময়লা নামানোর কাজ করছিলেন। দুর্ঘটনার সময় ক্রেনের একটি অংশ বিদ্যুতের তারের সাথে স্পর্শ করলে তিনি বিদ্যুতায়িত হন এবং নিচে পড়ে মারা যান।
দুর্ঘটনার কারণ ও নিরাপত্তার অভাব
নিহতের ছোট ভাই নয়ন হোসেন বলেন, “ভাইকে সুরক্ষা পোশাক ছাড়া কাজ করতে হয়েছে। মালিকপক্ষ নিরাপত্তা বেল্ট বা হেলমেট সরবরাহ করেনি। ১০ তলার উপর কাজ করছিলেন ভাই, তবুও কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।”
স্থানীয়রা জানান, নীলাচল টাওয়ারের নির্মাণ কাজ দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। কিন্তু কখনো শ্রমিকদের নিরাপত্তা পোশাক পড়তে দেখা যায়নি। সম্রাট হোসেন নামে এক দোকানদার বলেন, “ভবন নির্মাণের কাজ এখন শেষের দিকে, কিন্তু শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটি খুবই চিন্তার বিষয়।”
নির্মাণাধীন নীলাচল টাওয়ারের ম্যানেজার মাহবুব হাসান সাংবাদিকদের বলেন, “এটি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমরা নিহত শ্রমিকের পরিবারকে সহযোগিতা করব। শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু কেউ তা ব্যবহার না করলে আমাদের পক্ষ থেকে কিছু বলা যায় না।”
পুলিশের তদন্ত ও প্রাথমিক রিপোর্ট
যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসনাত জানান, দুর্ঘটনার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পরে মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বিদ্যুতায়িত হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখছে।
পুলিশ আরও জানিয়েছেন, “নির্মাণস্থলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যবস্থা যথাযথভাবে করা হয়েছে কিনা, সেটিও তদন্তের অংশ। প্রয়োজন হলে দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
শ্রমিকদের নিরাপত্তা: একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
এই ধরনের দুর্ঘটনা দেশে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার দিকে আরও একটি ইঙ্গিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্মাণশিল্পে নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব এবং প্রশিক্ষণের অভাব সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। হেলমেট, সেফটি বেল্ট, দস্তানা ও সঠিক পোশাক ছাড়া ১০ তলা বা তারও উপরে কাজ করা প্রাণঘাতী হতে পারে।
নির্মাণ শ্রমিকরা প্রায়ই দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন এবং নিরাপত্তা মানদণ্ড মানার সুযোগ কম থাকে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবন রক্ষা করতে সরকারের পক্ষ থেকে নির্মাণ শিল্পে নিরাপত্তা আইন কঠোরভাবে কার্যকর করা জরুরি।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে আসা নির্মাণ দুর্ঘটনা
দেশের বিভিন্ন স্থানে সময়ে সময়ে এই ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বড় বড় শহরে নির্মাণাধীন ভবন থেকে শ্রমিক পড়ে আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব, প্রশিক্ষণের ঘাটতি ও তদারকির অভাব এই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্মাণ শিল্পের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা মানদণ্ড থাকা অত্যাবশ্যক। প্রতিটি ভবনে শ্রমিকদের জন্য হেলমেট, সেফটি বেল্ট, হাত ও পায়ের সুরক্ষা এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার।
সমাজের দায়িত্ব ও সচেতনতা
নির্মাণ শ্রমিকদের জীবন রক্ষা কেবল মালিক বা শ্রমিকদের দায়িত্ব নয়, এটি সমাজেরও দায়িত্ব। স্থানীয় প্রশাসন ও শ্রম অধিদপ্তরের নিয়মিত তদারকি, সচেতনতা প্রচার এবং জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে এমন দুর্ঘটনা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব।
সাজ্জাদ হোসেনের মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব শ্রমিকদের জীবনকে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। এটি শুধুই একটি ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং একটি সামাজিক বার্তা। প্রতিটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে তাদের দায়িত্ব পালনে সচেতন হতে হবে।
পরিবার ও সমাজের ক্ষতি
নিহতের পরিবার বর্তমানে শোকের মধ্যে রয়েছে। ছোট ভাই নয়ন হোসেন জানান, “ভাইয়ের মৃত্যুর পর পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ। পরিবারের বড় উপার্জনকারী ছিল সে। এখন কে সংসার চালাবে, তা নিয়ে আমরা চিন্তিত।”
স্থানীয়দের মতে, শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে নেওয়া উচিত। প্রশাসন ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানদের আরও কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন মর্মান্তিক ঘটনা আর না ঘটে।
যশোরের এই দুর্ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তি বা পরিবারকে নয়, বরং পুরো সমাজকে সচেতন করার আহ্বান। নির্মাণ শিল্পে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপরিহার্যতা, শ্রমিকদের নিরাপত্তা সরঞ্জামের ব্যবহার এবং সরকারের তদারকি সবই জরুরি। সাজ্জাদ হোসেনের জীবন হার আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে, নিরাপত্তা উপেক্ষা করলে ক্ষতি শুধু শ্রমিকের নয়, তার পরিবার ও সমাজেরও হয়।
আমরা আশা করি, এই ধরনের দুর্ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না। নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও শ্রমিকরা মিলিতভাবে নিরাপত্তা মানদণ্ড নিশ্চিত করলে প্রতিটি শ্রমিক নিরাপদে তার জীবন যাপন করতে পারবে।
MAH – 13186 I Signalbd.com