
চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় গুয়াংডং প্রদেশে আঘাত হেনেছে শক্তিশালী টাইফুন মাতমো। রোববার (৫ অক্টোবর) দুপুরে উপকূলে আছড়ে পড়া এই ঝড়ের ফলে গুয়াংডং, হাইনান ও আশপাশের প্রদেশগুলোতে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ও ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়। বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৫১ কিলোমিটার, যা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে।
চীনে এই টাইফুন আঘাত হানে এমন এক সময়ে যখন দেশজুড়ে চলছে বছরের অন্যতম বড় ছুটি—জাতীয় দিবস উপলক্ষে ৮ দিনের সরকারি ছুটি। কোটি কোটি মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু ঝড়ের কারণে ট্রেন, বাস, ফেরি ও ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লক্ষাধিক যাত্রী চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
ফিলিপাইন থেকে চীনে মাতমোর অগ্রযাত্রা
টাইফুন মাতমো প্রথমে ফিলিপাইনের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক বৃষ্টি ও বন্যার সৃষ্টি করে। সেখানে বহু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হাজারো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। ফিলিপাইনে অন্তত ১০ জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়।
সেখানে শক্তি সঞ্চয় করে ঝড়টি সোজা দক্ষিণ চীনের দিকে ধেয়ে আসে। শনিবার পর্যন্ত এটি শক্তিশালী সামুদ্রিক ঝড় হিসেবে অবস্থান করলেও রাতারাতি তা পূর্ণাঙ্গ টাইফুনে রূপ নেয়। রোববার দুপুরে এটি গুয়াংডংয়ের সুয়েন শহর সংলগ্ন উপকূলে আঘাত হানে।
গুয়াংডং ও হাইনান প্রদেশে বৃষ্টি ও স্থবিরতা
টাইফুন মাতমোর প্রভাবে গুয়াংডং প্রদেশের বহু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানায়, উপকূলীয় অঞ্চলের নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে। একই সময়ে ছুটির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হাইনান দ্বীপে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে হাজার হাজার পর্যটক আটকা পড়েন।
বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গুয়াংডংয়ের রাস্তায় গাছ উপড়ে পড়েছে, গাড়ি চলাচল বন্ধ, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে গেছে। বহু এলাকায় বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
জাতীয় দিবসের ছুটিতে যাত্রীদের ভোগান্তি
চীনে জাতীয় দিবস (১ অক্টোবর) উপলক্ষে প্রতিবছর দীর্ঘ ছুটি থাকে। এই ছুটিকে বলা হয় গোল্ডেন উইক, যা চীনের ভ্রমণশিল্প ও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু এবার গোল্ডেন উইকের আনন্দ ম্লান করে দিলো টাইফুন মাতমো। কোটি কোটি মানুষ ভ্রমণের পরিকল্পনা করলেও ঝড়ের কারণে ট্রেন, বাস, বিমান ও ফেরি সেবা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পর্যটননির্ভর হাইনান ও গুয়াংডং প্রদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।
পরিবহন, ফেরি ও ফ্লাইট সেবায় স্থবিরতা
শনিবার সন্ধ্যা থেকেই ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে চীনা কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি প্রদেশে লাল সতর্কতা জারি করে। এরপর ধাপে ধাপে ট্রেন ও বাস চলাচল স্থগিত করা হয়।
হাইনান প্রদেশে সব ফেরি চলাচল বন্ধ করা হয়। গুয়াংডং প্রদেশের প্রধান বিমানবন্দর থেকে শতাধিক ফ্লাইট বাতিল করা হয়। এসব কারণে হাজার হাজার যাত্রী বিমানবন্দর ও রেলস্টেশনে আটকা পড়ে ভোগান্তিতে পড়েন।
মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি
চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থা জানায়, টাইফুন মাতমোর কারণে অন্তত কয়েক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের বহু মানুষকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফসলি জমি তলিয়ে গেছে, বিশেষ করে ধান ও সবজির ক্ষেত পানির নিচে চলে গেছে। মাছের ঘের ভেসে গেছে। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
সরকারের সতর্কতা ও উদ্ধার তৎপরতা
ঝড়ের আগেই চীনা আবহাওয়া অধিদপ্তর উপকূলীয় জনগণকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছিল। হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী প্রস্তুত রাখা হয়েছিল।
ঝড় আঘাত হানার পরপরই উদ্ধারকাজ শুরু হয়। সেনাবাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্কুল ও সরকারি ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পূর্ব এশিয়ায় টাইফুনের ইতিহাস ও মাতমোর তুলনা
পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রায় প্রতিবছরই টাইফুন আঘাত হানে। চীন, জাপান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম এই অঞ্চলের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ।
এর আগে ২০১৩ সালে টাইফুন হাইয়ান ফিলিপাইনে আঘাত হেনে ভয়াবহ ক্ষতি করেছিল। গত বছর চীনে আঘাত হেনেছিল টাইফুন হাগিবিস, যা কৃষিখাতে বিপুল ক্ষতি করেছিল।
তুলনামূলকভাবে টাইফুন মাতমো কিছুটা কম শক্তিশালী হলেও এর আঘাতের সময়কাল (গোল্ডেন উইক) ও প্রভাবিত অঞ্চলের অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে ক্ষতির মাত্রা বেশি হতে পারে।
ভবিষ্যৎ আবহাওয়ার পূর্বাভাস
চীনের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, টাইফুন মাতমো ধীরে ধীরে শক্তি হারাচ্ছে এবং আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সাধারণ ক্রান্তীয় নিম্নচাপে পরিণত হবে। তবে এর ফলে দক্ষিণ চীনের বিভিন্ন প্রদেশে এখনও ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
আগামী সপ্তাহে হুনান, ফুজিয়ান ও গুয়াংসি প্রদেশে বন্যার ঝুঁকি রয়েছে বলে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
চীনের জনগণ বছরের সবচেয়ে আনন্দঘন সময়ে যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। টাইফুন মাতমো শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং দেশের অর্থনীতি, পরিবহনব্যবস্থা ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
সরকারি তৎপরতা ও জনগণের সহযোগিতা থাকলেও এই টাইফুন আবার মনে করিয়ে দিলো, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও ঘন ঘন ও শক্তিশালী প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
MAH – 13178 I Signalbd.com