আঞ্চলিক

দুর্ঘটনায় মা হারানো শিশুটির কান্না থামছে না

Advertisement

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এক মা ও নানি। বেঁচে গেছে মাত্র এক বছরের শিশু সাফওয়ান ইসলাম। কিন্তু মাকে হারিয়ে শিশুটির কান্না থামছে না। প্রতিরাতেই সে মায়ের খোঁজে কাঁদছে, বাবার কোলে ঘুমাতে হচ্ছে। দুর্ঘটনার পর থেকে পরিবার ভেঙে পড়েছে শোকে, আর স্থানীয়রা বলছেন—অবৈধ রেলক্রসিং ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

ঘটনা বিস্তারিত

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সীতাকুণ্ড পৌর সদরের মৌলভীপাড়া এলাকায় রেললাইনে বিকল হয়ে পড়া একটি সিএনজি অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয় দ্রুতগামী ট্রেন। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান সানজিদা সুলতানা (২৫) ও তাঁর মা মাহমুদা বেগম (৪৫)। সানজিদার এক বছরের শিশু সাফওয়ান ও তার মামা কোনোমতে বেঁচে গেলেও মায়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না ছোট্ট শিশুটি।

শিশুর বাবা মো. ইমন ইসলাম জানান, “রাতে ঘুম ভাঙলেই সে কান্না শুরু করে। বারবার মাকে খোঁজে। বুকের দুধের সময় হলে কান্না থামানো যায় না। সারারাত তাকে বুকে নিয়ে রাখতে হয়।”

পরিবার

ইমন ইসলামের বাড়ি সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের ঘাটগড় এলাকায়। তিনি স্থানীয় একটি রড তৈরির কারখানায় চাকরি করেন। ২০২৩ সালের আগস্টে তাঁর বিয়ে হয় সানজিদা সুলতানার সঙ্গে। এর এক বছর পর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে জন্ম নেয় তাঁদের সন্তান সাফওয়ান। কিছুদিন আগে শিশুটির প্রথম জন্মদিন উপলক্ষে বাড়িতে আনন্দঘন পরিবেশ ছিল।

ইমন বলেন, “আমরা সবাই মিলে জন্মদিন পালন করলাম, অথচ মাস না যেতেই আমার ছেলেটি মাকে হারাল। সবকিছু তছনছ হয়ে গেল।”

দুর্ঘটনার কারণ

স্থানীয়রা জানান, মৌলভীপাড়ার যে স্থানে দুর্ঘটনা ঘটে সেটি একটি অবৈধ রেলক্রসিং। সেখানে কোনো গেটম্যান বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ঘটনার দিন বৃষ্টি থাকায় অটোরিকশার চারপাশে পর্দা টানানো ছিল। ফলে ট্রেন আসছে টের পাওয়া যায়নি। হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে চালক স্টার্ট দিতে চেষ্টা করছিলেন। ঠিক তখনই দ্রুতগামী ট্রেন এসে ধাক্কা মারে।

সানজিদার ভাই ইমাম হাসান বলেন, “আমি ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে নামতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার মা আর বোন বের হতে পারল না।”

দুর্ঘটনার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ক্রসিং এলাকায় সতর্কতামূলক নোটিশ টাঙিয়েছে—‘রেললাইনের ওপর দিয়ে কোনো যান চলাচল নিষিদ্ধ’। তবে স্থানীয়দের দাবি, রেললাইন সংলগ্ন জনবসতি ও মানুষের চলাচল বিবেচনায় ক্রসিংটি বৈধ ঘোষণা করে সেখানে গেটম্যান নিয়োগ করা উচিত।

শিশুর মানসিক অবস্থা

দুর্ঘটনার পর থেকেই এক বছরের সাফওয়ান বারবার মাকে খুঁজে কাঁদছে। তার মামা ও বাবা পালাক্রমে তাকে কোলে নিয়ে রাখছেন। দিনের বেলায় বাড়িতে লোকজন থাকায় কিছুটা সামলানো গেলেও রাতে কান্না থামানো যাচ্ছে না।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বয়সে শিশু তার মায়ের প্রতি গভীর আবেগ গড়ে তোলে। হঠাৎ করে মাকে হারানোয় শিশুটি দীর্ঘ সময় ট্রমার মধ্যে থাকবে। সঠিক যত্ন ও পরিবারের ভালোবাসা ছাড়া এ ট্রমা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হতে পারে।

স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া

স্থানীয় বাসিন্দা সোহরাব হোসেন বলেন, “এ রেলক্রসিংটি দিয়ে প্রতিদিন শত শত মানুষ যাতায়াত করে। অথচ কোনো গেটম্যান নেই। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুর্ঘটনার পর এখন নোটিশ টাঙানো হয়েছে। এটি পর্যাপ্ত সমাধান নয়।”

শিক্ষিত মহল বলছেন, দেশে এখনও প্রায় দেড়শর বেশি অবৈধ রেলক্রসিং রয়েছে। প্রতিনিয়ত এসব জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে। শুধু নোটিশ টাঙিয়ে দায়মুক্তি না নিয়ে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, অবৈধ রেলক্রসিংয়ের কারণে প্রতিবছর বহু প্রাণহানি ঘটে। দুর্ঘটনার শিকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ যাত্রী, স্কুলশিক্ষার্থী বা শ্রমজীবী মানুষ। সীতাকুণ্ডের এ দুর্ঘটনাও সেই ধারাবাহিকতারই একটি অংশ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রেললাইনসংলগ্ন এলাকায় নিরাপত্তা বাড়াতে স্থানীয় প্রশাসন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। না হলে এমন দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকবে

একটি দুর্ঘটনা মুহূর্তেই পরিবর্তন করে দিয়েছে সীতাকুণ্ডের ইমন ইসলামের পরিবার। স্ত্রীকে হারিয়ে তিনি একা সন্তান লালন করছেন। আর ছোট্ট সাফওয়ান প্রতিদিন মায়ের খোঁজে কান্না করছে। অবৈধ রেলক্রসিংয়ে এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঠেকাতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। না হলে আর কত পরিবারকে এভাবে ভেঙে পড়তে হবে?

এম আর এম – ১৬২৯,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button