
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এ রোগে আরও ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজারেরও বেশি রোগী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাণঘাতী এডিস মশাবাহিত রোগে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছরে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১২ জনে। নতুন করে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও এক হাজার ৪২ জন রোগী, যা একদিনে সর্বোচ্চ।
সর্বশেষ পরিস্থিতি ও আক্রান্তের সংখ্যা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত সময়ে নতুন করে ১,০৪২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৭১৭ জন পুরুষ ও ৩২৫ জন নারী।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে সর্বাধিক সংক্রমণ দেখা গেছে। ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৯৮ জন, দক্ষিণ সিটিতে ১২১ জন এবং সিটি করপোরেশনের বাইরে ঢাকা বিভাগে ২০১ জন ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়া বরিশাল বিভাগে ১৯৫ জন, চট্টগ্রামে ১০৪ জন, ময়মনসিংহে ৪১ জন, রাজশাহীতে ৮২ জন, রংপুরে ২৩ জন এবং সিলেট বিভাগে ৫ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন।
মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তি অবস্থা
গত ২৪ ঘণ্টায় ৯ জনের মৃত্যুর মধ্যে ৬ জন মারা গেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোতে। বাকি দুজন মারা গেছেন ঢাকা উত্তর সিটি ও চট্টগ্রামে। মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৪৯ হাজারের বেশি। আক্রান্তদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর অবস্থায় আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ডেঙ্গুর বিস্তার ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ ঢাকার বাইরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বরিশাল, গাজীপুর এবং রাজশাহী বিভাগে সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একদিনেই ভর্তি হয়েছেন ১৫০ জন রোগী।
ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কর্মজীবী এ জনগোষ্ঠী প্রতিদিন বাইরে বেশি সময় কাটায় এবং এডিস মশার সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি বেশি থাকে বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজীর আহমদ বলেন, “দিনের পর দিন ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে, অথচ সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব স্পষ্ট। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাব পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।”
আরেক জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “শুধু ঢাকায় নজর দেওয়া হচ্ছে, অথচ ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাপক হারে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া কোনো উন্নতি সম্ভব নয়।”
সরকারি উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনে বিভিন্ন কর্মসূচি নিলেও তা যথেষ্ট নয় বলে অভিযোগ উঠছে। নিয়মিত ফগিং ও লার্ভিসাইড স্প্রে চালানো হলেও অনিয়ম, নজরদারির অভাব এবং জনসচেতনতার ঘাটতি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।
অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন জেলা শহর ও পৌরসভায় মশা নিয়ন্ত্রণে প্রায় কোনো কার্যকর উদ্যোগই নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কারণে রাজধানীর বাইরে সংক্রমণ এখন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
পরিসংখ্যান: চলতি বছরের চিত্র
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪৯ হাজার ৯০৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৬ হাজারের বেশি রোগী ঢাকার বাইরে এবং প্রায় ১৩ হাজার রোগী রাজধানীতে।
মোট মৃত ২১২ জনের মধ্যে ১১০ জন পুরুষ এবং ১০২ জন নারী। এই সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ইতিমধ্যেই অনেক বেশি বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সামনে কী হতে পারে?
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরং বর্ষা ও পরবর্তী মৌসুমে মশার প্রজনন আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর সমন্বয় এবং জনসচেতনতা বাড়ানো ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
প্রশ্ন উঠছে, প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল চলতে থাকলেও কবে নাগাদ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে?
এম আর এম – ১৬২২,Signalbd.com