
গাজা ফ্লোটিলার ঘটনা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি অবরোধ চলমান। এই অবরোধ ভাঙার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও শান্তিপ্রেমীরা অংশ নেন গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে অবরোধের অমানবিকতা তুলে ধরা। কিন্তু গত সপ্তাহে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) জাহাজগুলো থামিয়ে দেয় এবং জোরপূর্বক শতাধিক কর্মীকে আটক করে নিয়ে যায়।
মালয়েশিয়ান অধিকারকর্মীর করুণ অভিজ্ঞতা
মালয়েশিয়ার তরুণ অধিকারকর্মী হাযওয়ানি হেলমি, যিনি ওই ফ্লোটিলায় অংশ নিয়েছিলেন, আটক হওয়ার পর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন,
“আইডিএফ সেনারা আমাদের পশুর মতো ব্যবহার করেছে। আমাদের খাওয়ার কিছু দেওয়া হয়নি, পরিষ্কার পানি বা ওষুধও দেয়নি। আটককৃতদের এমনভাবে রাখা হয়েছিল যেন আমরা অপরাধী নই, বরং যুদ্ধবন্দী।”
হেলমির এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বিবৃতির অংশবিশেষ ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে।
আমেরিকান অধিকারকর্মীর একই অভিজ্ঞতা
শুধু মালয়েশিয়ার হাযওয়ানি নন, আমেরিকান মানবাধিকারকর্মী উইন্ডফিল্ড বিয়াভারও একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন,
“আমাদের কোনো অপরাধ নেই। আমরা কেবল গাজায় ওষুধ, খাবার ও মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদেরকে শত্রুর মতো ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা না খেয়ে, না পানীয় জল পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি।”
গ্রেটা থানবার্গের প্রতি নির্যাতনের অভিযোগ
বিশ্বখ্যাত সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গও এই ফ্লোটিলায় যোগ দিয়েছিলেন। তিনি সবসময় ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং গাজার শিশুদের কষ্টের কথা বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছেন। কিন্তু এবার তিনি নিজেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
তুর্কি সাংবাদিক এরসিন সেলিক জানান, তিনি নিজ চোখে দেখেছেন গ্রেটাকে কীভাবে ‘টেনে হেঁচড়ে’ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এমনকি তাকে জোর করে ইসরায়েলি পতাকায় চুম্বন করানো হয়েছে। এরসিন বলেন,
“আমি জীবনে এমন দৃশ্য কখনো দেখিনি। গ্রেটার মতো একজন তরুণ শান্তিকর্মীকে এভাবে অপমান করা মানবতার জন্য লজ্জাজনক।”
গাজা অবরোধ: একটি মানবিক সংকট
২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের অবরোধ চলছে। এর ফলে প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং বিদ্যুতের ঘাটতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। জাতিসংঘ ও বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা এই অবরোধকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
কিন্তু ইসরায়েল দাবি করে, এই অবরোধ তাদের নিরাপত্তার জন্য জরুরি। তারা মনে করে গাজা থেকে হামাস রকেট ছোড়ে এবং অস্ত্র সরবরাহ করে। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এভাবে পুরো একটি জনগোষ্ঠীকে অবরুদ্ধ করে রাখা কোনোভাবেই ন্যায্য হতে পারে না।
অতীতের ফ্লোটিলা হামলা
এটি প্রথমবার নয়, এর আগেও গাজায় যাওয়ার পথে ফ্লোটিলাগুলোকে আক্রমণ করেছে ইসরায়েল। ২০১০ সালে মাভি মারমারা ফ্লোটিলা হামলা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন তুরস্কের নাগরিকসহ ৯ জন মানবাধিকারকর্মী নিহত হন। এরপর থেকেই গাজা ফ্লোটিলা শান্তিপ্রেমী ও মানবাধিকারকর্মীদের প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া, তুরস্ক, কাতারসহ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের এহেন আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিবও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং আটককৃতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু মানবাধিকার সংগঠন সরাসরি তদন্ত দাবি করেছে। তারা বলেছে, “যদি সত্যিই গ্রেটা থানবার্গকে জোর করে পতাকায় চুম্বন করানো হয়ে থাকে, তবে এটি আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ
টুইটার, ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে #FreeFlotilla এবং #StandWithGaza হ্যাশট্যাগ ইতিমধ্যেই লাখো মানুষ ব্যবহার করেছে। গ্রেটা থানবার্গের প্রতি আচরণকে কেন্দ্র করে বিশেষত ইউরোপে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনার পর গাজা অবরোধ ইস্যুটি আবারও বিশ্বমঞ্চে আলোচিত হবে। যদিও ইসরায়েল তাদের অবস্থানে অনড়, তবে আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতি অনেক বেড়েছে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় অংশগ্রহণকারীরা যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, তা আবারও প্রমাণ করেছে ফিলিস্তিন সংকট কেবল একটি আঞ্চলিক সমস্যা নয়, বরং এটি পুরো মানবতার জন্য একটি বড় প্রশ্ন। গ্রেটা থানবার্গ থেকে শুরু করে মালয়েশিয়ান ও আমেরিকান অধিকারকর্মীদের প্রতি নির্যাতন ইঙ্গিত করে—অবরোধ ভাঙার যে কোনো প্রচেষ্টাকে ইসরায়েল কঠোরভাবে দমন করতে প্রস্তুত।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কতদিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব থাকবে? গাজার মানুষের মৌলিক অধিকার কি আদৌ বিশ্ব নিশ্চিত করতে পারবে?
MAH – 13162 I Signalbd.com