স্বাস্থ্য

ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩৭৪ জন

Advertisement

দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এই মুহূর্তে অত্যন্ত উদ্বেগজনক আকার ধারণ করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৩৭৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে শনিবার (৪ অক্টোবর) পাঠানো প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

এ পর্যন্ত এই বছর ডেঙ্গুতে মোট ২০৩ জনের মৃত্যু ঘটেছে। মৃতদের মধ্যে ১০৬ জন পুরুষ এবং ৯৭ জন নারী। এছাড়া চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪৮,৪৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

ঢাকা এবং অন্যান্য বিভাগে ডেঙ্গুর প্রভাব

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি পরিস্থিতি নিম্নরূপ:

  • ঢাকা মহানগর: ৯৪ জন
  • চট্টগ্রাম বিভাগ: ১০২ জন
  • ঢাকা বিভাগ: ৬৭ জন
  • বরিশাল বিভাগ: ৬৩ জন
  • ময়মনসিংহ বিভাগ: ৩৭ জন
  • রাজশাহী বিভাগ: ১১ জন

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মূলত বড় শহরগুলোতে বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষত ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে থাকা, আবর্জনা ও নিকাশি সমস্যা এই রোগ ছড়ানোর জন্য প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।

ডেঙ্গু কী এবং এর লক্ষণ

ডেঙ্গু হলো এডিস মশা দ্বারা সংক্রমিত ভাইরাসজনিত রোগ। সাধারণত উষ্ণ, আর্দ্র পরিবেশে এডিস মশা বেশি সক্রিয় থাকে। ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:

  • হঠাৎ করে তীব্র জ্বর
  • মাথা ব্যথা
  • চোখের পেছনের ব্যথা
  • শরীর ও জয়েন্টে ব্যথা
  • বমি বমি ভাব
  • চামড়ায় র‍্যাশ

তবে যদি জ্বরের সঙ্গে রক্তপাত বা তীব্র দুর্বলতা দেখা দেয়, তাহলে তা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের লক্ষণ হতে পারে। এমন অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।

ডেঙ্গুর কারণ ও ঝুঁকি

ডেঙ্গু ছড়ায় মূলত এডিস এগিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস প্রজাতির মশা। এই মশা দিনের বেলায় সক্রিয় থাকে এবং বিশেষ করে জমে থাকা নোংরা পানির মধ্যে লার্ভা জন্মায়। ডেঙ্গু ছড়ানোর প্রধান কারণগুলো হলো:

  1. পানি জমে থাকা: বাসা-বাড়ির পাত্র, গার্ডেনের ড্রেন, টায়ার বা কন্টেইনারে পানি জমে থাকা।
  2. অপরিষ্কার পরিবেশ: আবর্জনা ও নিকাশির সমস্যা।
  3. শহুরে ঘনবসতি: ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মশার বৃদ্ধি বেশি।
  4. নিয়মিত স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব।

ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়

ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন:

  • পানি জমে রাখা না, নিয়মিত পানির ট্যাংক ও পাত্র ঢেকে রাখা।
  • মশার ঘরে ঢোকার পথ বন্ধ করা। দরজা ও জানালায় জালতি ব্যবহার করা।
  • মশা মারার স্প্রে বা লার্ভাসাইড ব্যবহার।
  • আঙ্গিনায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, আবর্জনা নিয়মিত ফেলা।
  • গা ঢাকা পোশাক পরা, বিশেষ করে সকালে ও বিকেলে মশার কামড় এড়াতে।
  • ডেঙ্গুর সম্ভাব্য লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে পরীক্ষা করানো।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি

ঢাকা ও চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার পুরান ও নবনির্মিত এলাকার তুলনায় উচ্চ ঘনবসতি এবং আবর্জনা ব্যবস্থাপনার সমস্যার কারণে ডেঙ্গু সংক্রমণ বেশি। চট্টগ্রামে বর্ষার পর থেকে ডেঙ্গুর সংখ্যা বেড়েছে। বরিশাল ও ময়মনসিংহেও ধীরে ধীরে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রাজশাহী ও রংপুরের মতো তুলনামূলকভাবে ছোট শহরগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কম থাকলেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের উদ্যোগ

স্বাস্থ্য অধিদফতর নিয়মিত মনিটরিং ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে:

  • প্রতিদিন বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা।
  • জনসাধারণের জন্য সচেতনতা মূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করা।
  • ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করা।
  • মশার লার্ভা ধ্বংসে অভিযান চালানো।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি জনগণকেও নিজের ঘর ও আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে হবে।

আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ

ডেঙ্গু শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং ভারতেও প্রতিবার বর্ষার সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলেছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা, পরিষ্কার পরিবেশ এবং মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সংখ্যা ৪৮,৪৬৫ জন। মৃত্যুর সংখ্যা ২০৩। সংখ্যার বিশ্লেষণে দেখা যায়, পুরুষ ও মহিলা উভয়েই আক্রান্ত হচ্ছেন, তবে পুরুষ রোগীর সংখ্যা কিছুটা বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো বর্ষার পর জমে থাকা পানি, শহুরে বসতি, আবর্জনা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব।

শেষ কথা

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো সচেতনতা। সরকার ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের উদ্যোগের পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারকে নিজের পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে। নিয়মিত পানি জমে না রাখলে, ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে এবং মশা প্রতিরোধক ব্যবহারে ডেঙ্গু রোগী হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সব নাগরিককে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। ডেঙ্গুর প্রকোপ যে কত দ্রুত বাড়তে পারে, তা দেখলে এটি বাংলাদেশের জন্য এখনই একটি বড় স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ।

MAH – 13157 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button