
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় চীন। বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়ে এ কথা জানিয়েছেন। বার্তায় তিনি দুই দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্ব, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ভবিষ্যতের উজ্জ্বল দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিস্তারিত মন্তব্য করেছেন।
ঢাকার চীনা দূতাবাস শনিবার (৪ অক্টোবর) এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। দূতাবাসের বরাতে জানানো হয়েছে, প্রেসিডেন্ট শি বার্তায় উল্লেখ করেছেন যে, চীন ও বাংলাদেশ একে অপরের প্রাচীন প্রতিবেশী এবং দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর: শি জিনপিং-এর দৃষ্টিভঙ্গি
শি জিনপিং বলেছেন, ১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই দেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিবর্তনের মধ্যেও দৃঢ় বন্ধুত্ব বজায় রেখেছে। তিনি বলেন, “চীন ও বাংলাদেশ সর্বদা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করে, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমতার ভিত্তিতে এবং সমন্বিত উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে একে অপরের সহযোগিতার উদাহরণ স্থাপন করেছে।”
শি জিনপিং আরও উল্লেখ করেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা এবং কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও দৃঢ় হয়েছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত, বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি জানান, চীন বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ককে উচ্চমাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছে এবং দুই দেশের জনগণের কল্যাণ ও বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নের জন্য যৌথ উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত।
রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের প্রতিক্রিয়া
রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন তার পক্ষ থেকে জানান, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে আরও দৃঢ় হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, এই বন্ধুত্ব শুধুমাত্র কূটনৈতিক সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাস্তব জীবনে দুই দেশের জনগণের জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুবিধা বয়ে এনেছে।
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আরও বলেন, “চীন আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নে চীনের দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার জন্য আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। দুই দেশের নেতা ও জনগণের যৌথ প্রচেষ্টা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও বৃহত্তর ফলাফলের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
বেল্ট অ্যান্ড রোড এবং অবকাঠামোগত সহযোগিতা
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিশেষ দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)। এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য, পরিবহন ও প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশকে সহায়তা করছে। উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে:
- পোর্ট অব চিটাগং ও মংলা পোর্ট উন্নয়ন
- সড়ক ও রেলপথের আধুনিকায়ন
- বন্দর ও শিল্প এলাকা সম্প্রসারণ
এছাড়াও, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ ও কৃষি খাতেও উল্লেখযোগ্য অংশীদারিত্ব রয়েছে। শি জিনপিং-এর বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে, ভবিষ্যতে এই সহযোগিতা আরও গভীর এবং ফলপ্রসূ হবে।
সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত বিনিময়
চীন এবং বাংলাদেশ শুধু কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। দুই দেশের শিক্ষার্থীদের বিনিময় প্রোগ্রাম, সাংস্কৃতিক উৎসব এবং গবেষণামূলক সহযোগিতা দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
চীনা দূতাবাস জানিয়েছে, এই ধরণের সাংস্কৃতিক বিনিময় দুই দেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং বন্ধুত্ব বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও কৌশলগত গুরুত্ব
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ। শি জিনপিং বার্তায় উল্লেখ করেছেন, দুই দেশের যৌথ প্রচেষ্টা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনও বলেন, “চীনের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা আঞ্চলিক শান্তি এবং আন্তর্জাতিক দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক।”
ভবিষ্যতের লক্ষ্য: আরও গভীর সহযোগিতা ও পারস্পরিক কল্যাণ
উভয় দেশের নেতারা একমত যে, ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আরও সম্প্রসারিত হবে। বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া হবে:
- অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি
- অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা
- শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যৌথ উদ্যোগ
- সাংস্কৃতিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিময়
শি জিনপিংয়ের বার্তায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-চীনের সম্পর্ককে আরও গভীর এবং দৃঢ় করতে, দুই দেশের নেতা ও জনগণের যৌথ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
৫০ বছরের বন্ধুত্বের মূল্যায়ন
১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক শান্তি, সমৃদ্ধি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্বাস ও কৌশলগত সহযোগিতা, বাণিজ্যিক বিনিময় এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ এই বন্ধুত্বের মজবুত ভিত্তি তৈরি করেছে।
চীন বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার এবং অবকাঠামোগত প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। এ ছাড়া, চীনের প্রযুক্তি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সমর্থন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূদৃশ্য পরিবর্তনের মধ্যেও চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রভাবশালী ও স্থিতিশীল রয়ে গেছে। দুই দেশের অংশীদারিত্ব আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত:
- বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ বৃদ্ধি
- সামুদ্রিক ও স্থলপথ বাণিজ্যে সহযোগিতা
- দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতার সমর্থন
শি জিনপিং এবং রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন উভয়েই বিশ্বাস করেন, এই সহযোগিতা শুধু দুই দেশের জন্য নয়, পুরো আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক উন্নয়নে সহায়ক।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি কেবল একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সহযোগিতা ও পারস্পরিক কল্যাণের পথনির্দেশ। শি জিনপিং-এর বার্তা এবং রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের প্রতিক্রিয়া স্পষ্টভাবে দেখায়, দুই দেশ একে অপরকে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে মান্য করে এবং বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নে যৌথ প্রচেষ্টায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই সহযোগিতা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাক্ষেত্রে আরও গভীর এবং ফলপ্রসূ হবে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশের ও চীনের পারস্পরিক বন্ধুত্বের স্থায়ী প্রমাণ হয়ে থাকবে।
MAH – 13155 I Signalbd.com