বিশ্ব

ইসরাইল ও আরএসএস যমজ ভাই, মোদি ট্রাম্পের চাকর

Advertisement

ভারতের রাজনীতি আবারও উত্তপ্ত হয়েছে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের সাম্প্রতিক মন্তব্যকে ঘিরে। তিনি ভারতের দক্ষিণপন্থী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-কে তুলনা করেছেন ইসরাইলের জায়নবাদী মতাদর্শের সঙ্গে। শুধু তাই নয়, দুই পক্ষকে তিনি আখ্যা দিয়েছেন “যমজ ভাই” হিসেবে। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সমালোচনা করে তাকে বলেছেন “ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাকর”।

বিজয়ন তার বক্তব্যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, অভিবাসন নীতি, ভিসা সমস্যা এবং মোদির নীরব ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেন। তার এই বক্তব্য শুধু কেরালাতেই নয়, বরং সমগ্র ভারতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় তুলেছে।

বক্তব্যের প্রেক্ষাপট

কেরালার উপকূলীয় শহর কান্নুরে ২ অক্টোবর (২০২৫) তারিখে এক জনসভায় এই মন্তব্য করেন বিজয়ন। এর একদিন আগেই (১ অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আরএসএসের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট ও স্মারক মুদ্রা উন্মোচন করেছিলেন।

বিজয়নের মতে, এটি ভারতের সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। কারণ আরএসএসকে অনেক সমালোচক ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান বিরোধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেন।

ইসরাইল ও আরএসএসকে কেন তুলনা করা হলো?

পিনারাই বিজয়ন বলেছেন, “আরএসএস ও ইসরাইলি জায়নবাদ একই মতাদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তারা উভয়ই জাতিগত আধিপত্য, ধর্মীয় বিভাজন এবং সমাজে বৈষম্য তৈরির পক্ষে কাজ করে। এ কারণে তাদেরকে যমজ ভাই বলা যায়।”

আরএসএস (RSS):

১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটিকে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের প্রধান বাহিনী হিসেবে দেখা হয়। বিজেপি-র উত্থানের পেছনে আরএসএসের বড় ভূমিকা রয়েছে। সমালোচকদের মতে, এই সংগঠন ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে দুর্বল করছে।

ইসরাইলি জায়নবাদ:

জায়নবাদ একটি রাজনৈতিক আন্দোলন, যা ইহুদি জাতির জন্য ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেছে। বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে দমননীতি ও দখলদারিত্বের জন্য জায়নবাদকে সমালোচনা করা হয়।

এই দুই মতাদর্শের মধ্যে মিল টেনে বিজয়ন বোঝাতে চেয়েছেন যে, তারা উভয়ই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দেয়।

মোদিকে ট্রাম্পের চাকর বললেন কেন?

বিজয়ন শুধু আরএসএসকেই সমালোচনা করেননি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন।

তিনি বলেন:

“মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা ফি বাড়ালেন, যখন ভারতীয় পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপ করলেন— তখনও মোদি নীরব ছিলেন। যদি আমাদের দেশে প্রকৃত আত্মমর্যাদাশীল নেতৃত্ব থাকত, তবে প্রতিরোধ গড়ে উঠত। কিন্তু মোদি ট্রাম্পের একজন চাকরের মতো আচরণ করেছেন।”

এইচ-১বি ভিসা ইস্যু

বিজয়নের সমালোচনার অন্যতম মূল কারণ হলো এইচ-১বি ভিসা ফি বৃদ্ধি। যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করা হাজার হাজার ভারতীয় আইটি বিশেষজ্ঞ ও প্রফেশনালের জন্য এই ভিসাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রাম্প প্রশাসন ভিসা ফি বাড়ানোর ফলে ভারতীয়দের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

ভারত সরকার এর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর অবস্থান নেয়নি।

বিজয়ন মনে করেন, এটি ভারতের মর্যাদার ওপর আঘাত।

অর্থনৈতিক ক্ষতি ও বাণিজ্য সংকট

বিজয়ন অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ালেও প্রধানমন্ত্রী মোদি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি।

এর ফলে—

ভারতীয় কৃষিপণ্য, টেক্সটাইল এবং আইটি খাত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

ভারতের শ্রমজীবী শ্রেণি ও ব্যবসায়ীরা সংকটে পড়েছেন।

অথচ সরকার এ নিয়ে কোনো কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয়নি।

আরএসএসের শতবর্ষ ও বিতর্ক

২০২৫ সালে আরএসএস তাদের ১০০ বছর পূর্তি উদযাপন করছে। এ উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদি স্মারক ডাকটিকিট ও মুদ্রা উন্মোচন করেন।

কিন্তু সমালোচকদের মতে, রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ধরনের উদ্যোগ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বিরুদ্ধে যায়। বিজয়ন এক্সে (পূর্বের টুইটার) লিখেছেন:

“আরএসএসের শতবর্ষ উদযাপন আমাদের সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি অপমান।”

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বিজয়নের এই বক্তব্যকে ঘিরে ভারতের রাজনীতিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

বিজেপি নেতারা বলেছেন, এটি ভারতের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ।

বামপন্থী ও কংগ্রেস শিবির বিজয়নের বক্তব্যকে সমর্থন করেছে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, বিশেষত ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যু ও ভারতের বিদেশনীতি প্রেক্ষাপটে।

ভারতের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক প্রভাব

ভারত বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম কৌশলগত মিত্র। তবে মোদি সরকারের নীতি অনেক সময় “আমেরিকা নির্ভর” হিসেবে সমালোচিত হয়।

বিজয়নের বক্তব্য থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক স্পষ্ট হয়—

ভারতের বৈদেশিক নীতি স্বাধীন নয়, বরং মার্কিন স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে।

আরএসএসের মতাদর্শ ভারতের বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থার জন্য হুমকি।

মোদি সরকার ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে ফিলিস্তিন প্রশ্নে নিরপেক্ষতা হারিয়েছে।

সমালোচনা বনাম বাস্তবতা

বিজয়নের বক্তব্য নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক। তবে এর পেছনে বাস্তব কিছু তথ্যও আছে—

যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় কর্মীদের ভিসা জটিলতা দীর্ঘদিনের সমস্যা।

বাণিজ্যে শুল্ক আরোপে ভারতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ইসরাইল-ভারত সম্পর্ক বিগত এক দশকে আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে।

তবে বিজেপি নেতাদের মতে, এসব সমালোচনা কেবল রাজনৈতিক স্বার্থে বলা হচ্ছে এবং এতে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।

কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে ভারতীয় রাজনীতিকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। একদিকে তিনি আরএসএসকে ইসরাইলি জায়নবাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন, অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের “চাকর” বলে আখ্যা দিয়েছেন।

এমন মন্তব্য শুধু রাজনৈতিক উত্তাপই তৈরি করেনি, বরং ভারতের গণতন্ত্র, সংবিধান ও পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যত দিক নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।

MAH – 13153 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button