ক্রিকেট

টেস্টের খেলোয়াড় সাদমান ইসলামের টি–টোয়েন্টি সেঞ্চুরি

Advertisement

বাংলাদেশের ক্রিকেটে সব সময়ই নতুন নায়ক উঠে আসে। কারও ব্যাটে, কারও বলে কিংবা মাঠে বিশেষ কোনো মুহূর্তে তারা আলো কাড়েন। তবে সাদমান ইসলামের নাম দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল মূলত টেস্ট ফরম্যাটের জন্য। অনেকে তাঁকে এক ধরনের “টেস্ট স্পেশালিস্ট” বলেই চিনতেন। অথচ সেই সাদমানই এবার আলোড়ন তুললেন এমন একটি জায়গায়, যেটি তাঁর সঙ্গে খুব কমই মেলানো হতো—টি–টোয়েন্টি ক্রিকেট।

সিলেটে অনুষ্ঠিত ২০২৫ এনসিএল টি–টোয়েন্টির ম্যাচে ঢাকা মহানগরের হয়ে বরিশাল বিভাগের বিপক্ষে সাদমান খেললেন তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম টি–টোয়েন্টি সেঞ্চুরি। মাত্র ৫৯ বলে ১০১ রান করে তিনি লিখে দিলেন নতুন ইতিহাস।

টেস্ট থেকে টি–টোয়েন্টি: এক ভিন্ন যাত্রা

সাদমান ইসলাম ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষেক করেন টেস্ট দিয়ে। এখন পর্যন্ত তিনি খেলেছেন ২৪টি টেস্ট ম্যাচ। টেস্টে তাঁর ব্যাটিং ভঙ্গি সবসময়ই ছিল ধীরস্থির ও ধৈর্যশীল, যা দলের জন্য ভরসা তৈরি করেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি খেলেছেন ৯৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ এবং ওয়ানডে ফরম্যাটে জাতীয় দলের হয়ে সুযোগ না পেলেও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে নামিয়েছেন ৯১ ম্যাচ

কিন্তু টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর সংখ্যা ছিল মাত্র ২০টি ম্যাচ। সেই ২০ ম্যাচের মধ্যে আগের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৫৪। ফলে অনেকেই তাঁকে এই ফরম্যাটে কার্যকর ব্যাটসম্যান হিসেবে ভাবতেন না। এমনকি সর্বশেষ পাঁচটি বিপিএল মৌসুমে তিনি কোনো দলের সঙ্গেই চুক্তি পাননি।

সেঞ্চুরির পথে ব্যাটিং মহিমা

আজকের ম্যাচে সাদমান ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা রূপে। শুরু থেকেই তিনি ব্যাট হাতে নিয়ন্ত্রণ নেন। মাঠজুড়ে ছড়িয়ে দেন শটের ফুলঝুরি। মাত্র ৫৯ বল খেলে ১০১ রানের ইনিংসটি সাজিয়েছেন ১১টি চার ও ৪টি ছক্কার মাধ্যমে।

১৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে রুয়েল মিয়ার ডেলিভারি স্কয়ার লেগে ঠেলে দুই রান নিয়ে পূর্ণ করেন নিজের কাঙ্ক্ষিত সেঞ্চুরি। মাঠে উপস্থিত দর্শকরা তখন দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে স্বাগত জানান এই বাঁহাতি ওপেনারকে।

এটি শুধু এবারের টুর্নামেন্টেই প্রথম সেঞ্চুরি নয়, বরং এনসিএল টি–টোয়েন্টির ইতিহাসে মোট তৃতীয় সেঞ্চুরি। এর আগে এনামুল হক ও জিশান আলম এই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন।

ম্যাচের পরিস্থিতি

ঢাকা মহানগর আগে ব্যাট করে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৬ উইকেটে সংগ্রহ করে ১৯৭ রান। এর মধ্যে সাদমানের ইনিংসই ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল। তিনি যখন আউট হন, তখন স্কোরবোর্ডে লেখা হয়ে গেছে ইতিহাস।

ইফতিখার হোসেনের বলে শেখ অন্তরের হাতে ধরা পড়ার আগে সাদমান খেলেন ৬১ বলে ১০১ রানের ইনিংস। তাঁর এই ইনিংসটাই মূলত ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

আগের সাফল্যের তুলনা

গত বছর এনসিএল টি–টোয়েন্টিতে ঢাকা মহানগরের হয়ে রংপুর বিভাগের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ৫৪ রান করেছিলেন সাদমান। এবারের আসরে প্রথম ম্যাচে সিলেটের বিপক্ষে করেছিলেন ৪৯ রান। ধাপে ধাপে তিনি যেন নিজেকে তৈরি করেছেন। আর আজ সেই প্রস্তুতির পূর্ণতা পেল তাঁর ব্যাটে।

সাদমানের প্রতিক্রিয়া

ম্যাচ শেষে সাদমান ইসলাম সংবাদমাধ্যমে বলেন—

“অনেকেই মনে করে আমি শুধু টেস্ট ক্রিকেটার। কিন্তু আমি সব ফরম্যাটে খেলার মতোই প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। টি–টোয়েন্টিতেও যে আমি ভালো করতে পারি, সেটাই দেখাতে চেয়েছি।”

তাঁর এই কথার ভেতরেই বোঝা যায় কতটা অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি এই ইনিংসের জন্য।

জাতীয় দলে ফেরার সম্ভাবনা

টি–টোয়েন্টিতে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ দলে ওপেনিং জায়গাটি স্থায়ী হয়নি। লিটন দাস, তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার, নাঈম শেখ—অনেকেই সুযোগ পেয়েছেন, তবে কেউই খুব নিয়মিত হতে পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে সাদমান ইসলামের এই ইনিংস নতুন করে জাতীয় দলের দরজা খোলার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)–এর একজন নির্বাচক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন—

“আমরা সাদমানকে সব সময়ই টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে চিনেছি। তবে এই ইনিংস প্রমাণ করল, সে টি–টোয়েন্টিতেও কার্যকর হতে পারে। সামনের সিরিজগুলোতে আমরা তাঁকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করব।”

টি–টোয়েন্টির জন্য সাদমানের নতুন প্রস্তুতি

যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য টেস্ট ও টি–টোয়েন্টির ব্যাটিং টেকনিক ভিন্ন। সাদমান জানিয়েছেন, তিনি গত এক বছর ধরে বিশেষভাবে কাজ করেছেন শর্ট ফরম্যাটের শট খেলতে। নেট সেশনে পাওয়ার হিটিং, রানিং বিটুইন দ্য উইকেট এবং শর্ট বল সামলানোর কৌশল অনুশীলন করেছেন নিয়মিত।

এই প্রস্তুতিরই ফল পাওয়া গেল আজকের ইনিংসে।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ

  • আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ: ২৪
  • প্রথম শ্রেণির ম্যাচ: ৯৪
  • লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ: ৯১
  • টি–টোয়েন্টি ম্যাচ: ২০
  • সর্বোচ্চ স্কোর (আগে): ৫৪
  • সর্বোচ্চ স্কোর (এখন): ১০১

এটি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং এনসিএল টি–টোয়েন্টির ইতিহাসেও অন্যতম সেরা ইনিংস।

ভক্ত ও সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভক্তরা প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন সাদমানকে। টুইটার ও ফেসবুকে ক্রিকেটপ্রেমীরা লিখছেন—

  • “টেস্ট স্পেশালিস্ট থেকে টি–টোয়েন্টির সেঞ্চুরিয়ান, অসাধারণ সাদমান।”
  • “বাংলাদেশ দল ওপেনার সংকটে ভুগছে। সাদমানই হতে পারে সমাধান।”
  • “এই ইনিংস প্রমাণ করল, সুযোগ পেলে সাদমান বিপিএলেও দুর্দান্ত খেলতে পারবে।”

সামনের পথ

সাদমান ইসলামের এই সেঞ্চুরি তাঁর ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ব্রাত্য থাকার পর টি–টোয়েন্টিতে এমন এক ঝলক দেখানো নিঃসন্দেহে নির্বাচকদের নজর কাড়বে। সামনে বিপিএলসহ জাতীয় দলের একাধিক সিরিজ রয়েছে। সুযোগ পেলে এই ফরম্যাটেও তিনি হতে পারেন নিয়মিত মুখ।

ক্রিকেটে অনেক সময়ই একজন খেলোয়াড়কে একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটের জন্য সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সাদমান ইসলাম প্রমাণ করেছেন, সুযোগ আর প্রস্তুতি থাকলে যেকোনো ফরম্যাটে নিজেকে প্রমাণ করা সম্ভব। তাঁর প্রথম টি–টোয়েন্টি সেঞ্চুরি কেবল একটি ইনিংস নয়, বরং তাঁর ক্যারিয়ারের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য এটি হতে পারে আশার আলো। কারণ ওপেনিং ব্যাটসম্যান সংকটের সময়ে সাদমান ইসলাম যদি ধারাবাহিকভাবে এমন পারফরম্যান্স করতে পারেন, তবে জাতীয় দল পাবে এক নতুন ভরসা।

MAH – 13151 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button