
গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি হামলায় পরিস্থিতি ক্রমেই সংকটজনক আকার নিচ্ছে। নতুন তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র সর্বশেষ হামলায় আরও ৬৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় গাজার মৃতের সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ২৮৮ জনে, যেটি এ অঞ্চলের জন্য একটি মর্মান্তিক মানবিক সংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তুর্কি বার্তাসংস্থা আনাদোলু শুক্রবার (৩ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনীর গাজার বিরুদ্ধে চলমান অভিযান ইতিমধ্যেই দুই বছর অতিক্রম করেছে। এই সময়ে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৬৬ হাজার ২৮৮ জন এবং আহতের সংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজার ১৬৫ জন।
সাম্প্রতিক হামলার বিশদ
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে আরও ৬৩ জনের মরদেহ আনা হয়েছে। একই সময়ে আহত হয়েছেন ২২৫ জন। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিহত এবং আহতের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। কারণ অনেক ফিলিস্তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে রয়েছেন এবং উদ্ধারকাজে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও জনবল না থাকায় তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে গেলে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও ৮০ জন আহত হয়েছেন। এভাবে, শুধু মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর সময় প্রাণ হারানো ফিলিস্তিনির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯৭ জনে, আর আহতের সংখ্যা ১৯ হাজার ৫৪ জনে।
গাজা: ইতিহাসে মানবিক সংকট
গাজা ভূখণ্ড বহু বছর ধরে ইসরায়েলি-বাহিনী এবং ফিলিস্তিনি দলে সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। এখানে ঘনবসতি, সীমিত সম্পদ এবং অবরুদ্ধ অবস্থা মানবিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রায়, যার কারণে আহতদের সঠিক চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।
গাজায় বিদ্যমান বিদ্যুৎ সংকট, পানি সরবরাহের অভাব, হাসপাতাল ও ওষুধের ঘাটতি এমনকি বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার অভাব পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করেছে। বিশেষত শিশু, নারী ও বয়স্কদের ওপর এ হামলার প্রভাব মারাত্মক।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গত বছরের নভেম্বরে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল।
এই হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা দ্রুত মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া এবং সশস্ত্র সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।
গাজার নাগরিকদের দুঃখ-দুর্দশা
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গাজার সাধারণ মানুষ এখন ভয়, অনিশ্চয়তা এবং দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বহু পরিবার নিজের বাড়িঘর হারিয়েছে, শিশুদের শিক্ষা ব্যাহত হয়েছে, এবং পুষ্টির অভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গাজার হাসপাতালগুলোও এখন সম্পূর্ণরূপে অতিরিক্ত চাপের মধ্যে রয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাদের কাছে পর্যাপ্ত ওষুধ ও সরঞ্জাম নেই। আহতদের অনেককে প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়াই ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করতে হচ্ছে।
মানবিক সহায়তা ও আন্তর্জাতিক চাপে বাধা
গাজার বিভিন্ন এনজিও এবং মানবিক সংস্থা চেষ্টা করছে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সরবরাহ করতে। কিন্তু সীমান্তে চলমান সংঘাত, নিরাপত্তাহীনতা এবং অবরোধের কারণে সহায়তা পৌঁছানো খুবই সীমিত। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, যদি অবরুদ্ধ অবস্থা ও হামলা চলতে থাকে, তাহলে গাজায় মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হবে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশুদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা, মানসিক চাপ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও, মহিলাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অপ্রাপ্য হয়ে গেছে।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা
গাজার সংঘাত নতুন নয়। ইসরায়েলি-বাহিনী এবং ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত বহু বছর আগের। তবে সাম্প্রতিক দুই বছরের অভিযান বিশেষভাবে ভয়াবহ। ২০১৯-২০২৫ সময়ে এই সংঘাতে নিহতের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু রাজনৈতিক সমাধানই গাজার দীর্ঘমেয়াদি শান্তি এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত কোনও কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ হয়নি।
নোট: আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের তথ্য
আনাদোলু, আল-জাজিরা, বিবিসি এবং ডয়চে ভেলে সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম নিয়মিতভাবে গাজার অবস্থা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছে। এ সব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বলা যায়, ইসরায়েলি হামলা এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টা এখনো চলমান।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত উদ্যোগ না নেয়, তাহলে নাগরিকদের হতাহতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে।
গাজার সংঘাত কেবল একটি রাজনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি মানবিক বিপর্যয়। প্রতিদিন মানুষ নিহত হচ্ছে, আহত হচ্ছে এবং তাদের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতা এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছানোই একমাত্র পথ, যা গাজার মানুষদের বাঁচাতে পারে।
বর্তমানে গাজা একটি মানবিক রেলায় দাঁড়িয়েছে। শিশু, নারী এবং বয়স্কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ধ্বংসপ্রায় হাসপাতালে চিকিৎসা সরবরাহ করা এবং মানবিক সহায়তা দ্রুত পৌঁছানো অত্যন্ত জরুরি।
MAH – 13147 I Signalbd.com