
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসন থামছেই না। কয়েক মাস ধরে চলমান হামলায় প্রায় ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ও শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছে—গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মারাত্মক সংকটে লাখো মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।
এ অবস্থায় গাজাবাসীর কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীরা “গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা” নামক উদ্যোগে ১৩টি ত্রাণবাহী জাহাজ পাঠান। এসব জাহাজে ছিল খাবার, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানি। কিন্তু আন্তর্জাতিক পানিসীমায় পৌঁছানোর পর দখলদার ইসরায়েলি নৌবাহিনী সেগুলো আটক করে। জাহাজের ক্রু এবং মানবাধিকার কর্মীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়।
জামায়াতের তীব্র নিন্দা ও নিরাপত্তার দাবি
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে আটককৃত ত্রাণবাহী জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক বিবৃতিতে বলেন:
“গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো আন্তর্জাতিক আইনে সুরক্ষিত অধিকার। অথচ ইসরায়েল জাহাজ ও মানবাধিকার কর্মীদের আটক করে মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধ করেছে।”
তিনি আরও বলেন, যদি দ্রুত ত্রাণ পৌঁছানো না যায় তবে হাজার হাজার নারী ও শিশু অনাহারে ও রোগে মারা যাবে।
ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলল তুরস্ক
ইসরায়েলের এ পদক্ষেপে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়,
“ত্রাণবাহী জাহাজ আটক এবং মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার করা এক প্রকার সন্ত্রাসী হামলা। এটি নিরীহ মানুষের জীবনকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।”
এছাড়া মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আয়ারল্যান্ডসহ একাধিক দেশ ঘটনাটিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানিয়েছে।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থার সতর্কবার্তা
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, গাজায় বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা আধুনিক যুগের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। কয়েক লাখ শিশু অপুষ্টি ও মানসিক আঘাতে ভুগছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। অনেকে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, যেকোনো মানবিক সহায়তাকে গন্তব্যে পৌঁছাতে দিতে হবে। কিন্তু ইসরায়েলের নৌবাহিনী ত্রাণ আটকে দিয়ে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে।
গ্লোবাল ফ্লোটিলা আন্দোলনের ইতিহাস
গ্লোবাল ফ্লোটিলা মূলত ২০১০ সালে শুরু হয়। তখনও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সমুদ্রপথে গাজায় ত্রাণ পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। ২০১০ সালের মে মাসে “মাভি মারমারা” নামের জাহাজে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হন। সেই ঘটনার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ শুরু হয় এবং ফ্লোটিলা আন্দোলন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পায়।
২০২৫ সালের এ ঘটনাটি সেই একই ধারাবাহিকতার অংশ। এবারও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীরা জীবন ঝুঁকি নিয়ে গাজায় ত্রাণ পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ইসরায়েল একই রকম সহিংস কৌশল প্রয়োগ করে তা ব্যাহত করেছে।
গাজায় দুর্ভিক্ষ ও মানবিক বিপর্যয়
গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রতিদিন ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, যদি দ্রুত আন্তর্জাতিক সাহায্য পৌঁছানো না যায়, তবে গাজায় এক নতুন দুর্ভিক্ষ শুরু হবে। পানীয় জলের অভাবে কলেরা, টাইফয়েডসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।
শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ২০০ শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান
জামায়াতসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ একযোগে দাবি জানাচ্ছে—
- ইসরায়েলের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে,
- আটক মানবাধিকার কর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে,
- গাজামুখী সব ত্রাণবাহী জাহাজের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে।
অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন,
“গাজাবাসীর প্রাণ বাঁচাতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। দখলদার ইসরায়েলকে থামাতে আন্তর্জাতিক আদালত ও জাতিসংঘকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
গাজা আজ মানবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। যুদ্ধ, ক্ষুধা, রোগ ও অবরোধে লাখো মানুষ মৃত্যুর মুখে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মানবিক দায়িত্ব হলো অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণ পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দেওয়া। ত্রাণবাহী জাহাজ আটক করে ইসরায়েল যে অমানবিকতা দেখিয়েছে তা কেবল ফিলিস্তিনিদের নয়, পুরো মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মানবাধিকারকামী মানুষের একটাই দাবি—গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে দিন, ফিলিস্তিনের শিশুদের বাঁচতে দিন।
MAH – 13137 I Signalbd.com